বিশ্বজমিন

এ এক আজব জমানা

মোহাম্মদ আবুল হোসেন

৩০ মার্চ ২০২০, সোমবার, ৪:৫১ পূর্বাহ্ন

এ এক আজব জমানা। মানুষ মরলে কেউ কাছে আসে না। পাড়ার মানুষ তো দূরের কথা, নিজ ঘরের মানুষই দূরে থাকে। লাশ দাফনের মানুষ নেই। অনেকটা গোপনে, সঙ্গোপনে লাশ দাফন করা হয়। পাড়া পড়শিরা কাঁদেন কিনা জানা যায় না। অনলাইন মানবজমিন-এ একটি ভিডিওসহ রিপোর্ট পড়ে ও দেখে আত্মা কেঁপে উঠেছে। এক স্বামী ‘নীরবে দাফন করলেন স্ত্রীকে’। ইন্টারনেট দুনিয়ায় দেখেছি, বিদেশে এম্বুলেন্সে করে কফিনে লাশ নিয়ে দাফন করা হচ্ছে। সেখানে কফিনটিও কেউ স্পর্শ করছেন না। কফিনে রশি লাগিয়ে টানছেন একজন। দু’জন দুটি লাঠি বা গাছের ডালের মতো কিছু দিয়ে কফিনকে আগলে দিচ্ছেন। অনেকক্ষণ কসরত করে রশিতে এক হ্যাঁচকা টানে লাশ টেনে নামালেন কবরে। ধপাস করে কবরের ভিতর গিয়ে পড়ল কফিন। কবরের ভিতর থেকে ধুলো উড়ে অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। এভাবে লাশ কবরে নামাতে দেখিনি কখনো। কফিন স্পর্শ না করার একটিই উদ্দেশ্য, তারা যেন করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত না হন। ইউটিউবে দেখা সেই দৃশ্যের সঙ্গে অনেকটা মিলে গেছে খিলগাঁও তালতলা কবরস্তানে ওই নারীর দাফন। রিপোর্ট অনুযায়ী তার নমুনা সংগ্রহ করেছে আইইডিসিআর। তা পরীক্ষা করা হবে। ওই মরহুমা চলে গেছেন, আসুক আস্তে সুস্থে রিপোর্ট। এই নমুনা কি আগে সংগ্রহ করা যেত না? তিনি মারা যাওয়ার আগে রিপোর্ট পাওয়ার কোনোই উপায় ছিল না? যখন ওই নারী আল্লাহর দরবারে হিসাবের খাতা নিয়ে হাজির, তিনি পাড়ি দিয়েছেন ওপাড়ে, তখন শুনতে হচ্ছে, রিপোর্ট আসবে। এ কোন জমানায় এসে পড়েছি আমরা।

চারদিকে চাপা আর্তনাদ। মানবাত্মা কাঁদছে। যেন এক একটি বাড়ি এক একটি জেলখানা এই ঢাকা শহরে। শুধু বাড়ি নয়, প্রতিটি ফ্লোর এক একটি সেলে পরিণত হয়েছে। এর মাঝে নিজেদের বন্দি করে আমরা শুধু দেখছি মৃত্যুর মিছিল। না, সরকারিভাবে এসব মৃত্যুর বেশির ভাগকেই করোনা বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে, আইসোলেশনে থাকা শিশু, নারী বা বৃদ্ধের মৃত্যু। আবার কখনো পত্রিকাগুলোতে বা অনলাইনে খবর আসছে করোনা ভাইরাসের সিম্পটম বা লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন কেউ কেউ। এসব মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি করোনায় তা কে নির্ধারণ করবে! পেশাগত দৃষ্টিতে যখন উপর থেকে চোখ মেলি, তখন সারাবিশে^ এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পাই। করোনা আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে অসংখ্য মানুষ। তাদের ভিডিও দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।

লাশ দাফনের জন্য মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না- এ কোন জমানায় এসে পড়েছি আমরা। মসজিদে নামাজ আদায় বন্ধ হয়েছে অনেক দেশে। পবিত্র মক্কা, মদিনায় কড়াকড়ি। সেখানে মূল চত্বরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। ইসলামের সুতিকাগার, যেখানে দিনরাত ২৪ ঘন্টা মানুষে মানুষে সয়লাব, হাঁটার মতো পথ পাওয়া কষ্ট, সেই মক্কা, পবিত্র কাবা জনশূন্য প্রায়। মসজিদ বন্ধ করে দিতে হয়, এমন পরিস্থিতি কি পৃথিবীতে এসেছে কখনো! এ দৃশ্যও আমাদেরকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। শুধু মসজিদ নয়, সব ধর্মের উপাসনালয়ও বন্ধ। এ কোন জমানায় এসে পড়েছি আমরা!

বাতাসে মড়াকান্না। প্রতিটি মানুষের বুকের ভিতর কান্না। নিঃশ^াস নিতেও ভয়। যদি বাতাসে করোনা ভাইরাস ঢুকে পড়ে শরীরে! যারা বেঁচে আছি, অন্তত বাতাসে নিঃশ^াস নিতে পারছি, তাদের মধ্যে আমরা সবাই জানি না, নিজে সুস্থ আছি কিনা। একটা কাশি হলেই বুকে উথাল-পাতাল শুরু হয়ে যায়। একটু গা গরম হলে মৃত্যুভয় গ্রাস করে। সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। সময় পেরিয়ে যায়। এক একটি দিন, এক একটি রাত যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে। তার মাঝে বাড়ি থেকে মায়ের ফোন- বাবা কেমন আছিস!
মাকে সত্যি বলতে পারি না। বলি- ভাল আছি মা। চিন্তা করো না। তবু মায়ের মন। ইন্টারনেটের কারণে মুহূর্তেই খবর রাষ্ট্র হয়ে যায়। গ্রামের বাঁশবাগানে বাঁশ কাটতে গিয়ে ছলিমুদ্দিনও কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দেখে নেন দুনিয়া। শুধু পাগল ছাড়া সবাই জেনে গেছেন দুনিয়ার খবর। তাই গ্রামে থাকা আত্মীয়-স্বজনের হতাশা ভাল আছি কিনা তা নিয়ে। তাদের ভয়- আল্লাহ না করুন, যদি করোনায় আক্রান্ত হই, এই আমার লাশটিও তারা দেখতে পাবেন না। রাস্তা দিয়ে নিতে দেবেন না পথচারীরা। এম্বুলেন্স একজন করোনা রোগীর লাশ বহন করতে চাইবে না। এ জন্য বুঝি তাদের ভয়টা বেশি। যদি করোনায় নিকটতম কেউ এই শহরে মারা যান, তার স্বজনরা হয়তো লাশটাও দেখতে পাবেন না। আর মা! কোনো মা কিভাবে এটাকে মেনে নেবেন! হয়তো এসব ভেবেই অস্থির হয়ে পড়েন মা। এ কোন জমানায় এসে পড়েছি আমরা!

পাশের দেশ ভারতে সব বন্ধ। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চীনসহ পশ্চিমা দুনিয়া বন্ধ। দিনের পর দিন ধসে পড়ছে অর্থনীতি। এমন হলে মানুষ বাঁচবে কি করে! শ্রমজীবী মানুষ, যারা দিন এনে দিন খান, তাদের কি অবস্থা হবে! যদি তারা ঘর থেকে বেরুতে না পারেন তখন এই অর্থনীতির সঙ্কটে আরো বড় অঘটন ঘটার আশঙ্কা করা যায়। পেট বাঁচাতে মানুষ কি করে আর কি না করে! যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ইউরোপ, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য দুমড়ে মুচড়ে গেছে। সব বন্ধ। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর হিসেবে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে ভাবা হয়, তার কথায়ও হতাশার সুর। তিনি নিউ ইয়র্ক সহ অনেক স্থান থেকে লকডাউন তুলে নেয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু রোববার তিনিই হতাশা, ভয় ছড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, আগামী দু’সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যুহার হবে সর্বোচ্ছ। তার প্রশাসনে মহামারি বিষয়ক সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ডা. অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মারা যাবেন এক লাখ থেকে দুই লাখ মানুষ। এরপরই ট্রাম্প সুর নরম করেছেন। তিনি বলেছেন, লকডাউন এপ্রিলের ৩০ তারিখ পর্যন্ত থাকবে। আসলে কোথায় চলেছি আমরা! দূরে কি আলোর রেখা দেখা যাবে! কি জানি! অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। আর ভাবছি এ কোন জমানায় এসে পড়েছি আমরা!
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status