প্রথম পাতা
যৌনপল্লীর শত শিশুর মা হাজেরা
মরিয়ম চম্পা
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শুক্রবার, ৯:৩৩ পূর্বাহ্ন
ছবি- জীবন আহমেদ
শত শিশুর মা হাজেরা বেগম! জীবনটা তার কাছে এক খেলা। জীবনের মূল্যবান সম্পদ হারিয়েছেন সেই ছোট সময়েই। দেখেছেন গাঢ় অন্ধকার জগৎ। এখন সেই জগতের সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন বুনছেন। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে তার কথা ‘ওরাই আমার ভ্যালেন্টাইন’। সত্যিই হাজেরা যেন ওদের মাঝেই ভালোবাসা খুঁজে পান। ওদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেন। ওদের নিয়েই ভবিষ্যতের বীজ বুনেন। এক সময় যৌন পল্লীর বাসিন্দা এখন যৌন পল্লীর সন্তানদের নিয়ে ঘর সংসার করছেন। যৌন পল্লীর দুঃখ আর দুর্দশা থেকে এসব সন্তানদের মুক্ত করতে রাজধানীর আদাবরে গড়ে তুলেছেন আশ্রয়কেন্দ্র। নিজের জমানো ৯ লাখ টাকা দিয়ে এর যাত্রা শুরু করেন। গতকাল দুপুর ১২টা। আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং সোসাইটির ৬/২ এর বাসার চতুর্থ তলায় উঠতেই চোখে পড়ে উৎসব আমেজ। ছেলে সুজনের কপালে পুইয়ের দানার লাল রং দিয়ে তিলক একে দিচ্ছিলেন হাজেরা বেগম। সামনে এসে অভ্যর্থনা জানালেন সংসারের বড় ছেলে সাহাদাৎ হোসেন রবিন। ডাক নাম বড় রবিন। হাজেরা বেগমকে সবাই আম্মু বলে ডাকেন।
রবিন আদাবরের একটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। বেলকুনিতে নিজের হাতে তৈরি ছোট্ট সবজি বাগান থেকে সবজি তুলছিলেন হাজেরা বেগম। কথা হয় সংগ্রামী নারী হাজেরা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভালোবাসা দিবসের সবচেয়ে বড় উপহার হচ্ছে আমার এই শত সন্তান। মা দিবস, ভালোবাসা দিবসে ওরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাকে চিঠি দিয়ে, ফুল দিয়ে, কাগজে চিত্রাঙ্কন করে লিখে ‘মা আমি তোমাকে ভালোবাসি’। আমার ছোট বাচ্চারা বলে মা, আই লাভ ইউ। কার আগে কে আমাকে উইশ করবে। আমি ওদের সবসময় বলি, তোমাদের নিজের যে মা আছে তাদের তোমরা ফোন দিয়ে উইশ করো। কিন্তু ওরা আগে আমাকে উইশ করে পরে যাদের মা বেঁচে আছে তাদের ফোন দিয়ে উইশ করে। তিনি বলেন, এবছর ভালোবাসা দিবসে আমাদের সবার পরিকল্পনা হচ্ছে সকালে ঘুম থেকে উঠে ডিম পরোটা দিয়ে নাস্তা করবো। এরপর বছিলার একটি স্কুলে পিকনিকে যাবো ওদের নিয়ে। আমরা সবাই লাল এবং কমলা রংয়ের মিশ্রনে গেঞ্জি পড়বো। সত্যি বলতে ভালোবাসা আমিতো ওদের কাছ থেকে প্রত্যেক দিনই পাই। প্রতিটি দিনই আমার কাছে ভালোবাসার।
একসময় যৌন পেশা ছেড়ে যৌনকর্মীদের সন্তানদের লেখাপড়া, খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে ব্যাংকে নিজের জমা প্রায় ৯ লাখ টাকা দিয়ে প্রথম আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলেন সাভারে। নিজের জমানো পয়সা দিয়ে গড়ে তোলেন যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া শিশুদের আশ্রয় কেন্দ্র। মানবজমিনের সঙ্গে তিনি তার দীর্ঘ জীবনের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। বলেন, আমি চেয়েছি যৌনল্লীতে জন্ম নেয়া এই বাচ্চাগুলোকে যেন বাধ্য হয়ে তাদের মায়ের পেশায় না আসতে হয়। অথবা অন্য কোনো অন্ধকার জগতের বাসিন্দা না হতে হয়। আমার বড় ছেলের নাম সাহাদাৎ হোসেন রবিন। ও এসএসসি পাশ করেছে। আমার এখানে ১৫জন মেয়ে ও ছেলে ৩৪ জন। সবার ছোট ছেলের বয়স তিন বছর। এখানে তিন ঘণ্টা বয়সের বাচ্চাও আছে। ওর মা মানসিক রোগী মিরপুর মাজারে থাকে। জন্মের তিন ঘণ্টা পর আমার এখানে নিয়ে আসি। এখানে যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে মাদকাশক্ত, টোকাই, ভবঘুরেসহ সব মায়ের সন্তানই রয়েছেন। যুদ্ধের সময় আমার জন্ম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ছোটবেলায় আমি হারিয়ে যাই। তখন থেকে রাস্তায় ছিলাম। যুদ্ধের সময় আমার জন্ম। বাবা খালে বিলে মাছ ধরতেন। গ্রামের বাড়ি ভোলা। মা-বাবার সঙ্গে মিরপুরে থাকতাম। ৬ ভাই বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। স্বাধীনের পর আমার ভাইকে জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা যান। তখন আমার বয়স ছিল দুই বছর। বাবা আবার বিয়ে করেন। এরপর আমাদের ভাই বোনদের বিভিন্ন জনের কাছে পালক দেয়। পালক নেয়া পরিবার ঠিকমত খেতে দিতেন না। না খাওয়ার যন্ত্রণায় আমি বাসা থেকে পালিয়ে ফুপুর বাসার উদ্দেশ্য মিরপুরের একটি বাসে উঠে ঘুমিয়ে পরি।
বাসটি আমাকে গুলিস্তান জিপিওর মোড়ে নামিয়ে দেয়। ওখানে অনেক টোকাই ছেলেমেয়ে ছিলো। ওদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। তখন খাবারের খুব আকাল ছিল। বিভিন্ন হোটেলে গরীবদের ফেন ভাত খেতে দিতো। ওগুলো খেতাম। সেখান থেকে প্রায়ই পুলিশ ধরে নিয়ে যেত। এরপর আমি বাসায় কাজ করেছি, কাগজ কুড়িয়েছি, চোর, পকেটমার বাচ্চাদের সঙ্গে থেকেছি। সকল কাজই করেছি। আমার যখন ১৪-১৫ বছর বয়স তখন দুজন নারী পুরুষ বাসায় কাজ দেয়ার কথা বলে ইংলিশ রোডের পতিতালয়ে আমাকে বিক্রি করে দেয়। সেখানে কেটে যায় অনেক বছর। ওখান থেকে পালিয়ে আসার পর আরেকজনে বিক্রি করে দেয় আরেকটি পতিতালয়ে। কয়েক বছর পর সেখান থেকেও পালিয়ে যাই। সব পতিতালয়ে আমি একটি জিনিস দেখেছি যে, সেখানে যে বাচ্চাদের জন্ম হয় তারাও মায়ের মত যৌনকর্মী হয়। ১৬ বছর বয়সে পুলিশ ভবঘুরেদের সঙ্গে আমাকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠায়। সেখানে একটি এনজিওর সহায়তায় ছয়মাস লেখাপড়া শিখি। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে কেয়ার বাংলাদেশ নামে একটি এনজিওর সঙ্গে কাজ করি। এরপর ২০০৩ সালে যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলি। সেখানে প্রায় ৭০-৮০ জন বাচ্চা ছিল। একসময় এনজিওর ফান্ড আসা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে নিজের জমানো ৯ লাখ টাকা দিয়ে ুশিশুদের জন্য আমরাচ নামে শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র চালু করি।
আমি এই আশ্রয়কেন্দ্র বা সংগঠনের প্রেসিডেন্ট। আরও ৭-৮ জন সদস্য রয়েছে। যারা কেউ সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই। ৬ টি রুম নিয়ে আমাদের এই শিশু কানন। এখানে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছে থেকে বিভিন্ন সহায়তা ও অনুদান পেয়ে সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছি। আমার এখানে সব ছেলে মেয়ে স্কুল কলেজে পড়ে। একসময় ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। আমার সন্তানদের হাতে বানানো বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করা হয়। আমার স্বপ্ন একদিন ওরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নাগরিক হয়ে নিজ পরিচয়ে মাথা উচু করে বাঁচবে। মায়ের ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে।
রবিন আদাবরের একটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন। বেলকুনিতে নিজের হাতে তৈরি ছোট্ট সবজি বাগান থেকে সবজি তুলছিলেন হাজেরা বেগম। কথা হয় সংগ্রামী নারী হাজেরা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভালোবাসা দিবসের সবচেয়ে বড় উপহার হচ্ছে আমার এই শত সন্তান। মা দিবস, ভালোবাসা দিবসে ওরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাকে চিঠি দিয়ে, ফুল দিয়ে, কাগজে চিত্রাঙ্কন করে লিখে ‘মা আমি তোমাকে ভালোবাসি’। আমার ছোট বাচ্চারা বলে মা, আই লাভ ইউ। কার আগে কে আমাকে উইশ করবে। আমি ওদের সবসময় বলি, তোমাদের নিজের যে মা আছে তাদের তোমরা ফোন দিয়ে উইশ করো। কিন্তু ওরা আগে আমাকে উইশ করে পরে যাদের মা বেঁচে আছে তাদের ফোন দিয়ে উইশ করে। তিনি বলেন, এবছর ভালোবাসা দিবসে আমাদের সবার পরিকল্পনা হচ্ছে সকালে ঘুম থেকে উঠে ডিম পরোটা দিয়ে নাস্তা করবো। এরপর বছিলার একটি স্কুলে পিকনিকে যাবো ওদের নিয়ে। আমরা সবাই লাল এবং কমলা রংয়ের মিশ্রনে গেঞ্জি পড়বো। সত্যি বলতে ভালোবাসা আমিতো ওদের কাছ থেকে প্রত্যেক দিনই পাই। প্রতিটি দিনই আমার কাছে ভালোবাসার।
একসময় যৌন পেশা ছেড়ে যৌনকর্মীদের সন্তানদের লেখাপড়া, খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে ব্যাংকে নিজের জমা প্রায় ৯ লাখ টাকা দিয়ে প্রথম আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলেন সাভারে। নিজের জমানো পয়সা দিয়ে গড়ে তোলেন যৌনপল্লীতে জন্ম নেয়া শিশুদের আশ্রয় কেন্দ্র। মানবজমিনের সঙ্গে তিনি তার দীর্ঘ জীবনের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। বলেন, আমি চেয়েছি যৌনল্লীতে জন্ম নেয়া এই বাচ্চাগুলোকে যেন বাধ্য হয়ে তাদের মায়ের পেশায় না আসতে হয়। অথবা অন্য কোনো অন্ধকার জগতের বাসিন্দা না হতে হয়। আমার বড় ছেলের নাম সাহাদাৎ হোসেন রবিন। ও এসএসসি পাশ করেছে। আমার এখানে ১৫জন মেয়ে ও ছেলে ৩৪ জন। সবার ছোট ছেলের বয়স তিন বছর। এখানে তিন ঘণ্টা বয়সের বাচ্চাও আছে। ওর মা মানসিক রোগী মিরপুর মাজারে থাকে। জন্মের তিন ঘণ্টা পর আমার এখানে নিয়ে আসি। এখানে যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে মাদকাশক্ত, টোকাই, ভবঘুরেসহ সব মায়ের সন্তানই রয়েছেন। যুদ্ধের সময় আমার জন্ম। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ছোটবেলায় আমি হারিয়ে যাই। তখন থেকে রাস্তায় ছিলাম। যুদ্ধের সময় আমার জন্ম। বাবা খালে বিলে মাছ ধরতেন। গ্রামের বাড়ি ভোলা। মা-বাবার সঙ্গে মিরপুরে থাকতাম। ৬ ভাই বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। স্বাধীনের পর আমার ভাইকে জন্ম দিতে গিয়ে মা মারা যান। তখন আমার বয়স ছিল দুই বছর। বাবা আবার বিয়ে করেন। এরপর আমাদের ভাই বোনদের বিভিন্ন জনের কাছে পালক দেয়। পালক নেয়া পরিবার ঠিকমত খেতে দিতেন না। না খাওয়ার যন্ত্রণায় আমি বাসা থেকে পালিয়ে ফুপুর বাসার উদ্দেশ্য মিরপুরের একটি বাসে উঠে ঘুমিয়ে পরি।
বাসটি আমাকে গুলিস্তান জিপিওর মোড়ে নামিয়ে দেয়। ওখানে অনেক টোকাই ছেলেমেয়ে ছিলো। ওদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। তখন খাবারের খুব আকাল ছিল। বিভিন্ন হোটেলে গরীবদের ফেন ভাত খেতে দিতো। ওগুলো খেতাম। সেখান থেকে প্রায়ই পুলিশ ধরে নিয়ে যেত। এরপর আমি বাসায় কাজ করেছি, কাগজ কুড়িয়েছি, চোর, পকেটমার বাচ্চাদের সঙ্গে থেকেছি। সকল কাজই করেছি। আমার যখন ১৪-১৫ বছর বয়স তখন দুজন নারী পুরুষ বাসায় কাজ দেয়ার কথা বলে ইংলিশ রোডের পতিতালয়ে আমাকে বিক্রি করে দেয়। সেখানে কেটে যায় অনেক বছর। ওখান থেকে পালিয়ে আসার পর আরেকজনে বিক্রি করে দেয় আরেকটি পতিতালয়ে। কয়েক বছর পর সেখান থেকেও পালিয়ে যাই। সব পতিতালয়ে আমি একটি জিনিস দেখেছি যে, সেখানে যে বাচ্চাদের জন্ম হয় তারাও মায়ের মত যৌনকর্মী হয়। ১৬ বছর বয়সে পুলিশ ভবঘুরেদের সঙ্গে আমাকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠায়। সেখানে একটি এনজিওর সহায়তায় ছয়মাস লেখাপড়া শিখি। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে কেয়ার বাংলাদেশ নামে একটি এনজিওর সঙ্গে কাজ করি। এরপর ২০০৩ সালে যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলি। সেখানে প্রায় ৭০-৮০ জন বাচ্চা ছিল। একসময় এনজিওর ফান্ড আসা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে নিজের জমানো ৯ লাখ টাকা দিয়ে ুশিশুদের জন্য আমরাচ নামে শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্র চালু করি।
আমি এই আশ্রয়কেন্দ্র বা সংগঠনের প্রেসিডেন্ট। আরও ৭-৮ জন সদস্য রয়েছে। যারা কেউ সরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই। ৬ টি রুম নিয়ে আমাদের এই শিশু কানন। এখানে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। বিভিন্ন ব্যক্তিদের কাছে থেকে বিভিন্ন সহায়তা ও অনুদান পেয়ে সন্তানদের নিয়ে বেঁচে আছি। আমার এখানে সব ছেলে মেয়ে স্কুল কলেজে পড়ে। একসময় ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। আমার সন্তানদের হাতে বানানো বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করা হয়। আমার স্বপ্ন একদিন ওরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নাগরিক হয়ে নিজ পরিচয়ে মাথা উচু করে বাঁচবে। মায়ের ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করবে।