দেশ বিদেশ

জীবন যেভাবে পাল্টে যায়

মানবজমিন ডেস্ক

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শুক্রবার, ৯:১১ পূর্বাহ্ন

পারিবারিক দেখাশোনার মাধ্যমে বিয়েও অনেক সময় বিস্ময় সৃষ্টি করে। এমনই বিয়ে হয়েছিল ভারতের উমা প্রেমানের। অসুখী সেই বিবাহিত জীবন এক পর্যায়ে তার জীবনকেই শুধু পাল্টে দেয়নি। একই সঙ্গে রক্ষা করেছে হাজারো অন্য মানুষের জীবন। কারণ, তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য অর্জন করেছিলেন দক্ষতা ও উদ্যোগ। উমা সব সময়ই দক্ষিণ ভারতে মন্দিরে গিয়ে বিয়ের রীতিতে বিয়ের স্বপ্ন দেখতেন। তিনি কল্পনা করতেন বিয়ে অনুষ্ঠান হবে নানা রঙের ফুলে বর্ণিল। পার্টি হবে সমুদ্র সৈকতে। কিন্তু তার ভাগ্যে তা ঘটেনি কখনো।

এখন থেকে ৩০ বছর আগে ফেব্রুয়ারির এক সকালের কথা এখনো স্মরণ করতে পারেন উমা। ওই সময় তার মা তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্রেমান থাইকাড়ের সঙ্গে। উমার তখন বয়স ১৯ বছর। প্রেমাণ ২৬ বছরের যুবক। ওই সাক্ষাতের আগে তাদের দেখাশোনা হয়নি কোনদিন। উমাকে তার মা বলে দিলেন, প্রেমান তার স্বামী। সেখানে কোনো উৎসব হলো না। বাজলো না কোনো গান। এমনকি কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানও হলো না। উমা বলেন, মা আমাকে বললেন ওই সময় থেকে আমি প্রেমানের সম্পত্তি। আমাকে বলা হয়েছিল, আমি তার স্ত্রী। তার সম্পদের ওপর আমার কোনো অধিকার নেই। প্রেমান তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে রাখলেন রাতে। উমা স্মরণ করতে পারেন, পুরো রাতে তিনি ঘুমাতে পারেননি। উপরে হাল্কা হলুদ সিলিং আর ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। এরপর সকাল ৬ টায় তার কাছে ফিরে যান প্রেমান। তাকে বলেন, তার সঙ্গে একটি বার-এ যেতে। তার এ কথা শুনে উমা চুপ করে বসে রইলেন। এ সময়ে কয়েক ঘণ্টায় বেশ কয়েকবার পানীয় পান করেন প্রেমান।

উমা বসে বসে ভাবতে থাকেন তার জীবন কি ভয়ানক অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উমাকে প্রেমান বললেন, তুমি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে উমা জানতে পারলেন তিনি প্রেমানের চতুর্থ স্ত্রী। প্রেমান তাকে জানান যে, তিনি যক্ষ্মা রোগে মারাত্মকভাবে ভুগছেন। উমার প্রধান কাজ হবে তার যত্ন নেয়া। উমা বড় হয়েছেন তামিলনাড়ুর কয়েম্বাটোরে। শৈশব থেকেই তিনি পিতা টিকে বালাকৃষ্ণাণের মতো একজন ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। তার পিতা ডাক্তারি পড়েছিলেন এক বছর। পরে তার এক চাচা তাকে পড়াশোনা থেকে বিরত রাখেন এবং তাদের কৃষিকাজে লাগিয়ে দেন। কিন্তু তিনি মৌলিক শিক্ষা ব্যবহার করে ক্ষত স্থানে ড্রেসিং করা, ড্রেসিং পরিবর্তন করা, জ্বরের চিকিৎসা করতে পারতেন। উমা শুনতে পেয়েছিলেন অনেক পরিবারের রোগীই তার পিতাকে উপহার দেন। তাই উমাও তার পিতার সঙ্গ দেয়া শুরু করেন। এ সময় তিনি দেখতে পান তার পিতা কাজের প্রতি কতটা সিরিয়াস। গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত একজন রোগীকে সেবা দেয়া দেখেন উমা। বলেন, ওই চিকিৎসা কারো পক্ষে দেয়া কঠিন। কিন্তু এতে অন্যদের উপকার হয়।

সময় ব্যয় হয়। তা দেখে উমার মা এ কাজের প্রতি অনীহা দেখাতে থাকেন। উমার বয়স যখন আট বছর তখন তার মা তাকে কিছু অর্থ দেন দিওয়ালি উৎসবে আতশবাজি কেনার জন্য। তিনি যখন ফিরে এলেন মাকে আর পেলেন না। উমা বলেন, পরে আমি বুঝতে পারি তিনি অন্য কাউকে ভালোবাসতেন। তার জন্যই তিনি পালিয়ে গেছেন। এতে আকস্মিকভাবে তিন বছর বয়সী ভাইয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে উমার ওপর। উমা তখনও জানতেন না কিভাবে রান্না করতে হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন তিনি শিখে নেবেন। উমা বলেন, এ অবস্থায় পাশের বাড়িতে গিয়ে আন্টিদের অনুরোধ করি আমাকে রান্না শিখিয়ে দিতে। তারা আমাকে বলেন, আমি পারবো না। কারণ, আমি অনেক ছোট। কয়েক দিনের মধ্যে বিভিন্ন রকম রান্না শিখে ফেলেন উমা। রান্না হয়ে ওঠে তার নিত্যদিনের রুটিনের অংশ। আমি ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে পড়তাম। সকালের নাস্তা বানাতাম। দুপুরের খাবার রান্না করতাম। তারপর সকাল ৯টায় স্কুলে যেতাম। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ছোট ভাইয়ের দেখাশোনা করে রাতের রান্না করতাম। আমার বন্ধুরা প্রতিদিন বিকালে খেলতো, জীবনকে উপভোগ করতো। কিন্তু আমার সুখ ছিল পরিবারের যত্ন নেয়ার মধ্যে।

উমা এক সময় তার মায়ের বিষয়ে চিন্তা করতে থাকেন। ভাবেন আর কখনো তার সঙ্গে দেখা হবে না। বেশ কয়েক বছর পরে উমার বয়স যখন ১৭ বছর তখন প্রতিবেশীদের সঙ্গে কয়েম্বাটোর থেকে ৮৭ মাইল দূরে বিখ্যাত গুরুভায়ুর মন্দির দেখতে যান তিনি। সেখানে একজন বলেন, তিনি একজন নারীকে দেখতে পেয়েছেন, যাকে দেখতে উমার মায়ের মতো। উমার নিজের ঠিকানা রেখে আসেন তার কাছে। এর দু’চারদিন পরে ডাকযোগে একটি চিঠি আসে তার কাছে। চিঠিটি লিখেছেন উমার মা।  

চিঠি পেয়ে মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গুরুভায়ুরে ছুটে যান উমা। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে উমা বুঝতে পারেন এক্ষেত্রে সমস্যা আছে। উমা বুঝতে পারেন তার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী অনেক অর্থ ঋণ নিয়েছে। তারপর তাকে ফেলে চলে গেছে। ওই সময় ঋণদাতারা তার কাছে অর্থ দাবি করছিলেন। উমা বলেন, আমি দেখতে পাই প্রতিদিন মানুষ আসছে তার বাড়িতে এবং টাকার জন্য তাকে হয়রান করছে। এটা দেখে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল।

এ সময় উমার মা’র সামনে একটিই সমাধানের পথ ছিল। তা হলো প্রেমানের সঙ্গে উমার বিয়ে দেয়া। প্রেমান ছিলেন অনেক অর্থশালী। ফলে তিনি তাকে ঋণমুক্ত করবেন বলে তার বিশ্বাস ছিল। কিন্তু এই বিয়েতে সম্মতি ছিল না উমার। এর চেয়ে তিনি কাজের সন্ধান করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। এরপর ফিরে যান পিতার কাছে। কিন্তু মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার কারণে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তার পিতা। উমা বলেন, আমি অর্থহীন হয়ে পড়ি। ভাগ্যকে মেনে নিই। প্রেমানের সঙ্গে বিয়েতে মত দেই। উমা স্মরণ করেন, প্রতিদিন কাজে যাওয়ার আগে প্রেমান আমাকে তার ঘরের ভেতর তালাবদ্ধ করে যেতো। কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বা বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না আমার। আমি একা ছিলাম। আমি ওয়ালের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। আস্থা ও নিজের ওপর সম্মান হারিয়ে ফেলি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমানের যক্ষ্মা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। বেশির ভাগ সময় স্বামীকে নিয়ে তিনি হাসপাতালে কাটাতে থাকেন। প্রেমানের সঙ্গে ঘর ছাড়ার সাত বছর পরে ১৯৯৭ সালে মারা যান প্রেমান। তার সম্পদের ওপর উমার কোনো অধিকার ছিল না। উমা বলেন, এতে জীবনে প্রথম নিজেকে মুক্ত বলে মনে হলো। আমি চাই নি স্বামী মারা যাক। আমি তাকে সাহায্য করতে পারতাম না। কিন্তু এটা বুঝেছি, তার জীবন আমাকে দিয়েছে দ্বিতীয় সুযোগ।

 প্রেমানের সঙ্গের দিনগুলোতে উমা দেখতে পেয়েছেন গরিব মানুষগুলো যথাযথ চিকিৎসা নেয়ার সামর্থ্য নেই। তাদের যে শুধু সামর্থ্য নেই, তা নয়। একইসঙ্গে ভালো চিকিৎসা সম্পর্কেও তাদের জানাশোনা নেই। তাদেরকে সহায়তা করা শুরু করেন উমা। তাদেরকে ফরম ফিলআপ করে দেন। সঠিক ডাক্তারের খোঁজ দেন। কখনো কখনো তাদের সমস্যার কথা শোনেন। দ্রুতই শত শত মানুষ তাকে ফোন দেয়া শুরু করলেন। তারা পরামর্শ চান। এভাবেই তিনি রোগীদের সেবা করে যাচ্ছেন। দেশে তখন খুব বেশি ডায়ালাইসিস সেন্টার ছিল না। আর কিডনিদাতার হারও নাই বললেই চলে। এই ধারা পাল্টে দিতে চেষ্টা করতে লাগলেন উমা। নতুন একটি সেন্টার খোলার জন্য তহবিল সংগ্রহ শুরু করলেন। তা দিয়ে কেরালার থিসুরে প্রথম চালু করেন একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার। এখন ভারতজুড়ে তার রয়েছে এমন ২০টি সেন্টার। এ কাজে অনেক ধনী পর্যন্ত তাকে অর্থ দান করছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status