এক্সক্লুসিভ

চট্টগ্রামে কমছে পুকুর বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

২৯ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৭:৪৮ পূর্বাহ্ন

২০০৬-০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) সর্বশেষ জরিপ মতে চট্টগ্রামে চার হাজার ৫২৩টি পুকুর থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে আছে মাত্র হাজারখানেক। গত একযুগে পুকুর কমে দাঁড়িয়েছে এ সংখ্যায়। আর পুকুরের পানির অভাবে ক্রমেই বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি। গত ২৪শে জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরীর পাঁচলাইশ থানার মির্জাপুল ডেকোরেশন গলির একটি বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পানির অভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বস্তির ৩০০ ঘর। ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে কোটি টাকারও বেশি।

চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র অফিসার আব্দুল মান্নান জানান, ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিটের ১৪টি গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও আশেপাশে কোনো পুকুর না থাকায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এতে বস্তির ৩০০ ঘর পুড়ে গেছে।

অভিযোগ আছে, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় অসাধু ব্যক্তিরা নগরীর পুকুর, দীঘি ও জলাধার ভরাট করছে। আইন অমান্য করে ভরাট করা জায়গায় স্থাপনাও নির্মাণ করেছে। অনেক স্থানে নির্মাণ কাজ চালাচ্ছে। ফলে বর্তমানে নগরী প্রায় জলাধার শূন্য হয়ে পড়ছে।

চউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ২০০৬-০৭ সালের সর্বশেষ জরিপে নগরে পাওয়া যায় চার হাজার ৫২৩টি জলাধার। এর পর কোনো জরিপ চালানো হয়নি। ১৯৫২ সালের নির্মাণ আইন মেনে চলি। সে অনুযায়ী যা করার করে থাকি। দলিলে যদি পুকুর কিংবা জলাধার না থাকে তাহলে কিছু করার সুযোগ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার পুকুর, দীঘি ও জলাশয় ছিল। ১৯৯১ সালে তা দুই হাজারে এসে ঠেকে। ১৯৯১ সালে জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপ অনুযায়ী চট্টগ্রামে দীঘি বা জলাধারের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ২৫০টি। ২০০৬-০৭ সালের চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ জরিপে পাওয়া যায় ৪ হাজার ৫২৩টি জলাধার। কিন্তু বর্তমানে আছে ১ হাজারেরও কম।

সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রায় ১৫ হাজার জলাধার দখল ও ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনাসহ বহুতল ভবন। তবে দীর্ঘ ১৩ বছরে নগরীতে কী পরিমাণ জলাধার নিশ্চিহ্ন হয়েছে তার সঠিক তথ্য কারো কাছে নেই। প্রতিনিয়ত দীঘি ভরাট ও জলাশয় ধ্বংসের কারণে নগরীতে পানির উৎস কমে যাওয়ায় আগুন নেভানোর কাজ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে দিন দিন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। পুকুর ভরাটের আগে ফায়ার সার্ভিস থেকে অনাপত্তিপত্র নেওয়ার নিয়ম থাকলেও কেউ তা নেন না বললেই চলে।

স্থানীয় ব্যক্তি, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীর ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লার রাজাপুকুর, দেওয়ান বাজারের দেওয়ানজি পুকুর, নন্দনকাননের রথের পুকুর, চান্দগাঁওয়ের মৌলভী পুকুর, ফিরিঙ্গিবাজারের দাম্মো পুকুর, বহদ্দারহাটের মাইল্যার পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দীঘি, কাট্টলীর সিডিএ এলাকার পদ্মপুকুর, উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দীঘি, মিনামার দীঘি, মোহাম্মদ খান দীঘি, কারবালা পুকুর, ভেলুয়া সুন্দরীর দীঘিসহ অসংখ্য পুকুর ও দীঘি ভরাট হয়ে গেছে।

সরজমিনে দেখা যায়, চতুর্মুখী ভরাটের শিকার ঐতিহ্যবাহী বলুয়ার দীঘি। দীঘির চারপাশে ধীরে ধীরে ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে স্থাপনা। আশপাশের অনেক মানুষ গোসল থেকে শুরু করে গৃহস্থালির কাজকর্ম এ দীঘির পানিতে সারেন। দীঘিটি প্রকাশ্যে ভরাট চলছে।

অক্সিজেন জালালাবাদ এলাকার মিরবাড়ী প্রকাশ হাজী জোহুরার বাড়ি সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে দুইশ বছরের পুরনো জোহুরা পুকুর। এলাকায় স্বচ্ছ পানির জন্য এ পুকুরের সুনাম ছিল নগরজুড়ে। একশ শতক জায়গার এই পুকুরটি বর্তমানে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। পুকুরটি কৌশলে বিভিন্ন পাশ থেকে ভরাট করে সেখানে মার্কেট ও ভবন নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুকুরের মূল মালিক আবদুল্লাহ মিয়ার একমাত্র ছেলে বজল আহমদ অসুস্থ হওয়ায় পুত্রবধূ মাজুমা খাতুনের নামে বেচাকেনা না করার শর্তে শুধু উন্নয়ন ও সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য মাজুমা খাতুন ওয়াক্‌ফ স্টেটে পুকুরটি দান করেন। একই অবস্থা আকবর শাহ থানা এলাকায় অবস্থিত মোহাম্মদ আলী পুকুরের। পুকুরটির পশ্চিম ও দক্ষিণাংশের বড় অংশ ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা।

পাঁচলাইশ থানার পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের হামজারবাগ এলাকার শত বছরের পুরনো হামজা খাঁ দীঘি অল্প অল্প করে দখলে নিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু স্থাপনাও নির্মাণ করা হয়েছে। বাঁশ পুঁতে, বেড়া দিয়ে চলছে দখল। স্থানীয় লোকজন এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরকে লিখিত অভিযোগ দিলেও নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা। একই থানা এলাকায় মোহাম্মদপুর বড় পুকুরের অবস্থা আরো করুণ। পুকুরের তিন কোনায় বালি ও পাথর দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। ঘাসে ভরা পুকুর গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। পুকুরের মাঝখানে টিনশেডের রিকশা গ্যারেজ ও অপর পাশে লম্বা করে ভাড়া বাসা তৈরি করা হয়েছে। এক কোনায় ভরাট করে খেলার মাঠ করা হয়েছে।

দখল দূষণে অনেক আগেই জৌলুস হারিয়েছে আগ্রাবাদ ঢেবা। ঢেবার স্থানীয় ছাত্রলীগ নামধারী যুবকরা পূর্ব-দক্ষিণ কোণে কিছু অংশ ভরাট করে তৈরি করেছে কাঁচাবাজার। যেখান থেকে তারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা আদায় করে। একই পাশে বাঁশ-খুঁটি পুঁতে ভরাট করার চেষ্টা চলছে।

বন্দর থানাধীন ইপিজেডের পূর্ব পাশে রয়েছে ইপিজেড মফিজের ডোবা। সবচেয়ে পুরনো ডোবাটি প্রভাবশালী মফিজ চৌধুরীর নামে। ১১ একর আয়তনের ডোবাটির চারপাশে দোকান বা বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে অনেক আগেই। বর্তমানে ডোবাটির মালিক বলে দাবি করেছেন মফিজের ছেলে মঈন চৌধুরী। চকবাজার কে বি আমান আলী রোডের বড় মিয়া মসজিদ শত বছরের পুরনো। মসজিদের লাগোয়া রয়েছে অংশীদারী মালিকানার প্রায় ৫ কানি আয়তনের বিশাল দীঘি। মসজিদের পাশে হওয়ায় বড় মিয়া মসজিদ পুকুর নামে পরিচিত পুকুরটি মসজিদের সম্প্রসারণের নামে ভরাট করছে মসজিদ কমিটি। শ্রমিকরা বালি দিয়ে পুকুর ভরাটের কাজ করছে। জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশ গুপ্ত বলেন, জলাধার ভরাটের বিষয়ে আমরা প্রচুর মামলা করেছি। অধিদপ্তরের আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সবরকম ব্যবস্থা করে থাকি। তবে আমাদের নজরে আসা সাপেক্ষে। নজরে না এলে তো আলাদাভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাহারা দিতে পারি না।

তিনি বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০ (সংশোধিত) অনুযায়ী যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ দূষণ, জলাশয় ভরাট করাসহ সব ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়মূলক কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। জলাশয় ভরাট করাসহ পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজের বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যক্তি মামলা দায়ের করতে পারবে। চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাধার সংরক্ষণে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই দায়ী। ফলে একদিকে যেমন ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে কী পরিমাণ জলাশয় আছে, এর সঠিক চিত্র সংশ্লিষ্টদের কাছে নেই। বর্তমানে চট্টগ্রামে এক হাজারেরও কম জলাশয় রয়েছে বলে জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status