এক্সক্লুসিভ

হঠাৎ বেড়েছে খুনের ঘটনা

মরিয়ম চম্পা

২৩ জানুয়ারি ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:১৫ পূর্বাহ্ন

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় পারিবারিক কলহের জের ধরে স্ত্রী-শাশুড়িসহ দুই প্রতিবেশীকে হত্যার পর নির্মল কর্মকার আত্মহত্যা করেছে। রোববার ভোররাতে পারিবারিক কলহ নিয়ে নির্মল কর্মকারের সঙ্গে তার স্ত্রী জলির ঝগড়া হয়। এরই জের ধরে সে জলিকে দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। এ সময় জলিকে বাঁচাতে তার মা লক্ষ্মী ও পাশের ঘরের বসন্ত ভৌমিক এবং বসন্তের মেয়ে শিউলী এগিয়ে এলে নির্মল তাদেরও কুপিয়ে হত্যা করে।

এদিকে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায় ছেলের হাতে বাবা খুন ও মাকে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, উপজেলার শ্বেতি নারায়ণপুর গ্রামের বড় বাড়িতে তুচ্ছ ঘটনায় পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এক পর্যায়ে পুত্র আকবর হোসেন (৪০) তার পিতা চেরাগ আলী (৭৫) কে ধারালো দা দিয়ে কোপানো শুরু করে। এ সময় আকবরের মা ফুলমতি (৬৫) ঘটনাস্থলে ছুটে আসলে তাকেও কোপায় আকবর। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই চেরাগ আলী মারা যায়। আকবর চেরাগ আলীর বড় ছেলে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা এ দুটো ঘটনায় দেখা যায়, তুচ্ছ ঘটনায় মানুষ খুনের মতো ভয়ঙ্কর কাজ করছে।

খোদ রাজধানী ঢাকায় ২০১৯ সালে ২০১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালের ৭ই জানুয়ারি থেকে ২৫শে ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব খুনের ঘটনা ঘটে। বছর শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়। এসব খুনের ঘটনায় সবচেয়ে আলোচিত বুয়েটের আবরাব ফাহাদ হত্যাকাণ্ড। গত বছরের ৭ অক্টোবর বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয়ার জেরে এ হত্যাকাণ্ড বলে পুলিশ জানায়।

গত বছরের ৭ই জানুয়ারি রাজধানীর ডেমরা এলাকায় নুসরাত জাহান ও ফারিয়া আক্তার দোলা নামের দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ডেমরা থানায় একটি হত্যা মামলা করে নিহত নুসরাতের বাবা পলাশ। ২১শে জানুয়ারি রাজধানীর ভাটারায় যমুনা ব্যাংকের বুথের মধ্যে নিরাপত্তা কর্মী মো. শামীমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৮শে জানুয়ারি মতিঝিল থানার ফকিরাপুল এলাকায় অথরা আক্তার লুসি নামের এক তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১০ই ফেব্রুয়ারি ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা পারভীন চৌধুরী নিজ বাসায় খুন হন। নিহতের স্বামী ইসমত কাদির গামা বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন। ২০শে জুন পুরান ঢাকার বংশালে কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ উল্লাহ অভিকে হত্যা করা হয়। গত ১লা নভেম্বর ধানমন্ডিতে আফরোজা বেগম ও গৃহকর্মী দিতি আক্তার নামের দুই নারী খুন হন।

গত ৪ঠা ডিসেম্বর মিরপুরে রহিমা বেগম ও সুমি আক্তার নামের দুই নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা যায়, টাকা ভাগাভাগির কারণেই তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এই মামলায় রমজান ও ইউসুফ নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। একইদিন রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী থেকে রুবাইয়াত শারমিন রুম্পা নামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। যদিও তার মৃত্যুর কারণ এখনো উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। রুম্পার বাবার করা মামলায় কথিত বন্ধু আবদুর রহমান সৈকত গ্রেপ্তার হয়েছেন। ১১ই ডিসেম্বর বনানী এলাকায় গাওজিয়াং হুই নামের এক চীনা নাগরিকের লাশ উদ্ধার করা হয়। টাকার লোভেই তাকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ জানায়। ১২ই ডিসেম্বর ফকিরাপুলে শহিদুল ইসলাম ও মর্জিনা বেগম নামের দম্পতির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায়, স্বামী শহিদুল ইসলাম তার স্ত্রী মর্জিনাকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছেন। সর্বশেষ গত ২৫শে ডিসেম্বর মহাখালী এলাকায় নিজ বাসায় খুন হন ব্যবসায়ী তোবারক হোসেন। দোকান থেকে তাড়িয়ে দেয়ায় তার কেয়ারটেকারসহ পাঁচজন মিলে তাকে হত্যা করে।

অপরাধ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর পেছনে অন্যতম কারণ পরকীয়া, জমিসংক্রান্ত বিরোধ, মাদকের অর্থ জোগাড় ইত্যাদি। এছাড়া ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে বীভৎস বিকৃত খুনের ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে অপেশাদার খুনিদের মাধ্যমে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, খুন খারাবি বেড়ে যাওয়ার কারণ আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। সমাজে বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়ে দাড়াচ্ছে। সমাজে একদল ধনী শ্রেণি আরেক দল একেবারে নিন্মবিত্ত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠি। সেই কারনে সহিংসতা বেড়ে গেছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে এখানে জবাবদিহিতা নেই। সেই সঙ্গে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের সব ধরনের আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। যদি আইনের শাসন থাকতো তাহলে মানুষ এগুলো করতে ভয় পেত। আমাদের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে গেছে। এগুলো প্রতিরোধে আমাদের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। নৈতিকতার চর্চা থাকতে হবে।  

পুলিশের সাবেক আইজিপি ও সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, সমাজবিশ্লেষক সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে এর একটি সমাধান বের করা প্রয়োজন। আসলে হচ্ছেটা কি। এসকল খুন ও নৃশংসতা বাড়ার পেছনে অসহিষ্ণুতা দায়ী। এর অনেকগুলো কারণ আছে। মাদকের ব্যবহার এবং অপব্যবহার এখন মহামারি রুপ নিয়েছে। এটাকে যে কোনো মূল্যে রোধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদেরকে এটা নিয়ন্ত্রণে যত্নশীল হতে হবে। না হলে এটা বাড়তেই থাকবে। সবার মিলিত প্রয়াসে কাজটি করতে হবে। জনপ্রতিনিধি, সমাজের ভালো অবস্থানে যারা আছেন তাদের সঙ্গে নিয়ে আইনের প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি খুব জরুরী। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের মত সাইকো এ্যনালাইসিস করতে হবে।

অপরাধ বিজ্ঞানি তৌহিদুল হক বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় দেখি কখনো ধর্ষণের সংখ্যা, কখনো খুনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর পেছনে অবশ্য আলাদা আলাদা কারণ আছে। গত কয়েক দিনে যে খুনের ঘটনা ঘটেছে এর পিছনে আমরা দেখছি বিশেষ করে পরিবারের সদস্যরা, কম বয়সী সদস্যরা ও যুব সম্প্রদায়, তারা মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দ্বিতীয়ত মাদক ক্রয়ের প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে না পেরে নিজের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা বা আহত করার ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি এই খুন ও সহিংশতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে যেমন মাদকাসক্তকে আমরা অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছি। একই সঙ্গে এটাও বলতে চাই আমাদের যে চলমান সমাজ ধারা এই স্থানগুলোতে পরিবর্তনটা খুব অপরিহার্য। এছাড়া সামাজিক সম্প্রিতি, পরস্পর বোঝাপাড়া এবং একসঙ্গে মিলে মিশে থাকার যে প্রবণতা সেই বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশের নাগরিক যারা মাদকাসক্ত অথবা কেউ অভাবে আছেন তাদের দিকটি বিবেচনা করতে হবে। সব কিছু মিলিয়ে এই পরিস্থিতিগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র মানবিকভাবে বিবেচনা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status