এক্সক্লুসিভ

মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলা

মিসাইলের ইতিহাসে নয়া অধ্যায়

মানবজমিন ডেস্ক

২২ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৭:২৪ পূর্বাহ্ন

১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ইসরাইল ও সৌদি আরবে অনেকগুলো স্কাড মিসাইল নিক্ষেপ করেছিলেন। দুই দেশের যেসব লক্ষ্যবস্তুকে তিনি টার্গেট করেছিলেন মিসাইলগুলোর একুরেসি খারাপ হওয়ার কারণে তার কোনোটিই টার্গেটে আঘাত হানতে পারেনি। টার্গেট থেকে মিসাইলগুলো গড়ে দুই কিলোমিটারেরও দূরে গিয়ে আঘাত হেনেছিলো। এটি ওই শহরের বাসিন্দাদের আতঙ্কিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে শত্রুর স্বার্থে আঘাত হানতে এগুলো ছিল অকার্যকর। হাস্যকর হলেও সত্য যে, সে সময় ইসরাইলের যত মানুষ মিসাইলের আঘাতে মারা গিয়েছিলেন তার থেকেও বেশি মারা গিয়েছিলেন হার্ট অ্যাটাকে। যদিও ইসরাইল থেকে অপেক্ষাকৃত কাছে থাকা সৌদি আরবের একটি মার্কিন ঘাঁটিতে সাদ্দামের মিসাইল হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ সেনা নিহত হয়েছিল। তবে সেটিও সরাসরি মিসাইল হামলায় নয়। আকাশে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি মিসাইলের ধ্বংসাবশেষ একটি ব্যারাকের ওপর পড়লে ওই নিহতের ঘটনা ঘটে। এ থেকে একটি জিনিস সপষ্ট হয়ে যায় যে, মিসাইল থাকা থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটি কত নিখুঁতভাবে গিয়ে তার লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্ভুল হামলার একচ্ছত্র অধিপতি ছিল। কিন্তু সমপ্রতি ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের মিসাইল হামলার পর নিশ্চিতভাবেই নির্ভুল হামলায় মার্কিন প্রযুক্তির সুনামে ভাগ বসিয়েছে ইরান।

ইরানের আল কুদ্‌স ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরাকের মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আইন আল-আসাদকে লক্ষ্য করে মিসাইল হামলা চালায় ইরান। গত ৮ই জানুয়ারি হামলার পর স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে ওই ঘাঁটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সপষ্ট হয়ে যায়। ইরানি ব্যালেস্টিক মিসাইলগুলো মার্কিন ঘাঁটির একদম কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে। সেখানে ছিল যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও বেশ কয়েকটি ভবন। অন্তত ৬টি ইরানি মিসাইল সরাসরি ঘাঁটিতে আঘাত করে সেদিন। এটি কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার বদলা হিসেবে যথেষ্ট ছিল বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ভিপিন নারাং এ নিয়ে বলেন, ওই ঘটনার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ইরান তাদের স্বল্পপাল্লার মিসাইলগুলোকে কতখানি নির্ভুলভাবে ব্যবহার করেছে। দেশটির এই নির্ভুল হামলার সক্ষমতা রীতিমতো বৈপ্লবিক এবং এটি আর যুক্তরাষ্ট্রের একার অধিকারে নেই। আধুনিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ব্যাপক।

মিসাইলের একুরেসি নির্ধারণ করা হয় এর সিইপি দিয়ে। সিইপি হচ্ছে টার্গেটকে কেন্দ্র করে তার থেকে কত দূরে মিসাইল আঘাত করে সেই মাত্রা। অর্থাৎ যে মিসাইলের সিইপি যত কম সেটি তত বেশি নির্ভুল। বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি মিসাইলের সিইপি ছিল অসম্ভব রকমের কম। যদিও ইরান কোথায় টার্গেট করেছিল সেটি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তারপরেও তাদের ধারণা টার্গেটের সর্বোচ্চ ১০০ মিটারের মধ্যেই মিসাইলগুলো হামলা চালাতে সক্ষম হয়। বেশ কয়েকটির সিইপি ছিল ৫ মিটারেরও কম। গত বছরের ১৪ই সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে যে মিসাইল হামলা হয়েছিল সেটিও ছিল উচ্চ পর্যায়ের নির্ভুল হামলা। মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি হামলার পর সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলায় নির্ভুলতার রহস্যও সপষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ইরান কী করে এমন একুরেসি অর্জন করেছে? গত বছরের নভেম্বরে এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে ইরানের গাইডেন্স টেকনোলজি ও ম্যান্যুভ্রাবিলিটিতে অসামান্য উন্নয়নের কথা জানানো হয়। তবে মিসাইলকে নির্ভুলভাবে পরিচালনা করার অনেকগুলো পথ রয়েছে। ইরান তার সবগুলোতেই উন্নতি করেছে।

তবে ইরান শুধু নিজের কাছেই এসব প্রযুক্তি রেখে দেয়নি বরঞ্চ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে দেশটির পরিচালনা করা সশস্ত্র দলগুলোকেও তা সরবরাহ করেছে। এটিই ইরানকে আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লেবাননের ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে ইরান গাইডেন্স সিস্টেম ও মিসাইল দুটোই সরবরাহ করে যাচ্ছে। হিজবুল্লাহর কাছে হিসাব অনুযায়ী অন্তত ১ লাখ ৫০ হাজার রকেট রয়েছে। যা সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী  বিশ্বের অনেক দেশের থেকেও বেশি।

২০০১ সালে ইরান অবৈধভাবে অন্তত ৬টি রাশিয়ান কেএইচ-৫৫ মিসাইল কেনে। সেখান থেকে দেশটি এর নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করে। পরবর্তীতে ভয়ানক সেই মিসাইল দেশটি ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সরবরাহ করে। এগুলোই সৌদি আরবের অভ্যন্তরে হামলা চালাতে ব্যবহার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হামাস, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের দেয়া মিসাইল ও রকেট প্রযুক্তি ইরানকে সত্যিকারের যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসবের কার্যকারিতা নির্ণয়ে সাহায্য করে। ফলে দেশটি দ্রুত এই প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধনে এগিয়ে যাচ্ছে।

(লন্ডনের বিখ্যাত ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status