বাংলারজমিন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই হাসপাতালে ভুল চিকিৎসার শিকার পাপিয়াও

স্টাফ রিপোর্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে

১৫ জানুয়ারি ২০২০, বুধবার, ৭:২৮ পূর্বাহ্ন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্রিষ্টিয়ান মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছেন পাপিয়া নামের আরো এক রোগী। এনিয়ে আদালতে দায়ের করা মামলার তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। আদালতের নির্দেশে জেলার সিভিল সার্জনের গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের তদন্ত করে। ১২ই জানুয়ারি আদালতে জমা দেয়া হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন। শুধু ভুল চিকিৎসা নয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা অবৈধভাবে বিভিন্ন ডিগ্রি ব্যবহার করছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। হাসপাতালটিতে সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা না থাকার কথাও বলা হয়েছে এতে। এরআগে স্কুল শিক্ষিকা নওশীন আহমেদ দিয়াকে (২৯) ভুল চিকিৎসা ও ওষুধ প্রয়োগে মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগে হাসপাতালটির পরিচালক ডাক্তার ডিউক চৌধুরী ও হাসপাতালে কর্মরত দুই চিকিৎসক অরুনেস্বর পাল অভি ও মো. শাহাদাত হোসেন রাসেল ১লা জানুয়ারি জেলে যান।

পাপিয়াকে ভুল চিকিৎসা করার অভিযোগে তার পিতা আবুল খায়েরের দেয়া মামলায় ডিউক চৌধুরী ছাড়াও হাসপাতালের চেয়ারম্যান তার স্ত্রী ডাক্তার এঞ্জেলা চৌধুরী, ডাক্তার অরুনেশ্বর পাল ও তনুশ্রী রায়কে আসামি করা হয়। আদালতের নির্দেশে জেলার সিভিল সার্জন ৫ই ডিসেম্বর ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার মাসুম ইফতেখারকে এই কমিটির প্রধান করা হয়। কমিটির অন্য ৩ সদস্য হচ্ছেন- ডাক্তার ফৌজিয়া আখতার ও মো. মাহমুদুল হাছান, সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী মো. জাহিদুল হক। তদন্ত কমিটি ১৭ই ডিসেম্বর তদন্ত কার্য্যক্রম সম্পন্ন করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়- তদন্ত কমিটি পাপিয়ায় চিকিৎসায় নানা ত্রুটি পায়।

তাদের রিপোর্টে বলা হয়, রোগীর (পাপিয়া) আলট্রাসনোগ্রামে সঠিক রিপোর্ট না আসার ফলে রোগীর রোগ নির্ণয় সঠিকভাবে হয়নি এবং পরবর্তীতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। এইরূপ জটিলক্ষেত্রে অভিজ্ঞ সনোলজিস্ট দ্বারা দ্বিতীয়বার আলট্রাসনোগ্রাম করার পর চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত ছিলো বলে মত প্রকাশ করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২রা মার্চ রোগীকে যখন খ্রিষ্টিয়ান মেমোরিয়াল হাসপাতালে আনা হয় তখন রোগীকে ভর্তি করা হয়নি। ডিএন্ডসি অপারেশন নোটে ডাক্তার এমএ মজিদের নাম দেখা যায়। কিন্তু তার কোন ব্যবস্থাপত্র পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র ডাক্তার অরুনেশ্বর পালের ব্যবস্থাপত্র দেখা যায়।  হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডাক্তার এমএ মজিদ দায়িত্ব প্রাপ্ত চিকিৎসক ছিলেন বলে জানালেও দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র না পাওয়াটা দুঃখজনক বলে উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এমন একটি আধুনিক হাসপাতালে এধরনের ইমার্জেন্সি অপারেশনের জন্যে সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কোন ব্যবস্থা নেই। এছাড়া হাসপাতালের চিকিৎসকগণ এমবিবিএস ডিগ্রির পর যেসকল ডিগ্রি ব্যবহার করছেন তা বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অনুসারে বৈধ নয়। এরআগে নবীনগরের বড়াইল ইউনিয়নের জালশুকা গ্রামের মো. আবুল খায়ের তার মেয়ে পাপিয়ার ভুল চিকিৎসার অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট আদালতে একটি মামলা করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়- দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পাপিয়ার তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হলে তাকে খ্রিষ্টিয়ান মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কোন পরীক্ষা ছাড়াই হাসপাতালের চিকিৎসকরা পাপিয়ার ডিএনসি করার পরামর্শ দেন এবং তার কাছ থেকে ৫৮০০ টাকা ফি নেন। পাপিয়া ও তার স্বজনদের আপত্তির পরও ডিএনসি করেন তারা। কিন্তু ডিএনসি করার সময় পাপিয়ার জরায়ুর রক্তনালী কেটে ফেলা হয়। পরে কোনরকমে সেলাই দিয়ে রিলিজ দেয়া হয়। এরপর শহরের বাসায় নিয়ে যাওয়ার পরপরই প্রচণ্ড ব্যথা ও রক্তপাত শুরু হয় তার। এরপর আবারো তাকে ওই হাসপাতালে নিয়ে আসলে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ভর্তির পর সেখানে পাপিয়ার জটিল অপারেশন করা হয়। ১২ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়। জীবন বাঁচলেও সে স্বাভাবিক চলাফেরা করার সক্ষমতা হারিয়েছেন। জেলার সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. শাহআলম জানান- পাপিয়ার ঘটনায় আদালতে মামলা হলে আদালত এবিষয়ে তাকে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি তদন্ত কমিটি করেন। তদন্ত কমিটির দেয়া রিপোর্ট ১২ই জানুয়ারি আদালতে জমা দিয়েছেন।  

তবে স্কুল শিক্ষিকা নওশীন আহমেদ দিয়ার (২৯) মৃত্যুর ঘটনায় ওই হাসপাতাল ও এর চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা দেয় সব মহলে। দিয়ার পিতা শিহাব আহম্মদ গেন্দু হাসপাতালের ৩ চিকিৎসককে আসামি করে গত ১২ই নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এই মামলায় জেলে যান হাসপাতালটির মালিক ডাক্তার ডিউক চৌধুরী, ডাক্তার অরুনেস্বর পাল অভি ও মো. শাহাদাত হোসেন রাসেল। ৪ঠা নভেম্বর ভোরে প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় আক্রান্ত দিয়াকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করার পর ভুল ইনজেকশন ও ওষুধ প্রয়োগে তার মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ করা হয় মামলায়। এরআগে ৩০শে অক্টোবর ওই হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে দিয়ার আগাম ডেলিভারির ব্যবস্থা করা হয়। অভিযোগ করা হয় দিয়ার মৃত্যুর পরও হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার মুখে অক্সিজেনের মুখোশ লাগিয়ে দুপুর ১টার দিকে দ্রুত তাকে ঢাকা নিয়ে যেতে বলেন। এম্বুলেন্সে করে দিয়াকে বিকেল সাড়ে ৪টায় ঢাকা ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার ডাক্তাররা দিয়াকে মৃত এবং কয়েক ঘণ্টা আগেই মৃত্যু হয়েছে বলে জানান। রোগীর স্বজনদের অনুরোধের পরও মেডিসিনের অভিজ্ঞ চিকিৎসক না ডেকে হাসপাতালের ডাক্তাররা চুপ থাকেন। এই মামলায় ১লা জানুয়ারি জেলে যান ডাক্তার ডিউক চৌধুরীসহ ৩চিকিৎসক। দিয়ার শ্বশুর শহরের প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার এবিএম তৈমুর বলেন- রোগীর বয়স ও অবস্থা বিবেচনায় ইসিজি, ইকো কারডিও গ্রাফ, লিভার ফাংশন টেস্ট, লিপিড প্রোফাইল এসবের পরীক্ষা দরকার ছিলো। আমাকে পরে অন্য চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রোগীর বয়স যেহেতু ২৯ বছর ছিলো, সেহেতু সিজারের পূর্বে এসব পরীক্ষা জরুরি ছিলো। কিন্তু তারা কোন কিছুরই পরীক্ষা করেননি। তাছাড়া রোগীর খিচুনি না থাকার পরও নেলেপসিন জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করেন ডিউক ও ২ চিকিৎসক। ২০১৯ সালের ১লা জুন ভুল চিকিৎসায় পারভীন বেগম (২৮) নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয় ডিউকের হাসপাতালে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status