বিশ্বজমিন

অর্থনীতির দুর্দশায় প্রতিশোধস্পৃহা কমে গেছে ইরানের

পিটার এস গুডম্যান

১৪ জানুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার, ৩:৪৭ পূর্বাহ্ন

 তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে ইরান। চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। অর্থনীতির গতি তলানির দিকে। নাগরিকরা ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ইরানের প্রবেশাধিকার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে অর্থনীতি রীতিমত পঙ্গু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলছে, প্রতি বছর ইরানের অর্থনীতির আকার ৯.৫ শতাংশ গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের তথ্য মতে, দেশটির তেল রপ্তানি বস্তুত শূন্যে নেমে এসেছে এই ডিসেম্বরে। নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল বিক্রি হচ্ছে না। তবে চোরাইপথে অজ্ঞাত পরিমাণ তেল বিক্রি হয়েছে।

অর্থনীতির এই করুণ দশার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হওয়ার স্পৃহা হ্রাস পেয়েছে ইরানের। দেশটির নেতারা সচেতন যে, যুদ্ধ বাধলে জাতীয় সম্পত্তি তছনছ হয়ে যাবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক চাপ ও দুর্নীতির কারণে প্রায়শই দানা বাধছে বিক্ষোভ। এসব প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেশটির চরমপন্থি শাসকগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অথচ, মাত্র এক সপ্তাহ আগেও ট্রাম্প প্রশাসন যখন ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করে, তখন ইরানজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়। কিন্তু সম্প্রতি সরকার স্বীকার করে নেয় যে, ইউক্রেনের একটি বেসামরিক বিমান ভুলক্রমে ভূপাতিত করেছে সেনারা। এরপর তেহরানে ফের বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

যদিও নতুন বিক্ষোভ মূলত ওই বিমান দুর্ঘটনা ধামাচাপা চেষ্টার প্রতিবাদে, তবুও বৃহত্তর ক্ষোভও এজন্য দায়ী। জীবনযাত্রার মান ক্রমেই কমছে। বাড়ছে অর্থনৈতিক চাপ। নাগরিকরা মনে করছেন, বড় ধরণের সমস্যার মুখে শাসক গোষ্ঠী রীতিমত মিইয়ে যায়।

দেশে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৪০ শতাংশ। ফলে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম উর্ধ্বমুখী। প্রতি চারজন ইরানি যুবকের একজন বেকার। নতুন কলেজ শেষ করে আসা তরুণরা চাকরি পাচ্ছেন না।

জেনারেল সোলেইমানি হত্যার বিপরীতে গত সপ্তাহে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে সেসব হামলায় তেমন হতাহত হয়নি কেউ। ফলে আমেরিকানরাও খুব বেশি ক্ষুব্ধ নয়, তবে ইরানি নেতারা বলতে পারছে যে, প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে।

আমেরিকার প্রতিক্রিয়া দেখালে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আরও বাজে অবস্থায় চলে যাবে। বিশেষ করে, মুদ্রা আরও দুর্বল হবে। মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে। এছাড়া জাতীয় শিল্প বলতে যা অবশিষ্ট আছে, তা ধসে পড়বে, চাকরি কমে যাবে। ফলে চাপ বাড়বে নেতৃত্বের ওপর।

সংঘাত বাধলে অনেক কোম্পানি ধসে যাবে। ফলে স্থানীয় ব্যাংকগুলোও হুমকিতে পড়বে। ব্যাংকগুলোর ঋণের কারণেই অনেক কোম্পানি এখনও টিকে আছে। ব্যাংকের সম্পত্তির প্রায় ৭০ শতাংশই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আইএমএফ-এর সাবেক উপপরিচালক আদনান মাজারির একটি গবেষণা বলছে এ কথা। ব্যাংকঋণের প্রায় অর্ধেকই বকেয়া।

অনেক ইরানি কোম্পানি আমদানিকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। মেশিন, স্টিল থেকে শুরু করে শস্যও কিনে ইরান। ইরানের মুদ্রা যদি আরও হ্রাস পায়, ইরানের কোম্পানিগুলোকে এসব পণ্যের জন্য আরও অর্থ ব্যয় করতে হবে। ব্যাংককে আরও ঋণ দিতে হবে, নয়তো ব্যবসা ধসে পড়বে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকদিন ধরেই সরকারি ব্যয় নির্বাহ করছে। এ কারণেই কৃচ্ছ্রসাধন এড়াতে পারছে সরকার। ব্যাংক নোটপ্রিন্ট হচ্ছে বেশি, যা মুদ্রার দরে প্রভাব পড়ছে। যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিলে ধনী ইরানিরা নিজ দেশ থেকে অর্থ অন্যত্র পাচার করবে। ফলে মুদ্রার ওপর আরও চাপ বাড়বে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি।

ফলে এ কথা বলা যায় যে, বেশ চাপের মুখে ইরানি নেতৃত্ব। অর্থনীতি চালিয়ে নিতে ব্যাংক ও শিল্পকারখানায় ঋণ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারে সরকার। কিন্তু এতে শেষ অবদি ব্যাংক ও শিল্পখাতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। নতুবা ব্যয় কমানোর দিকে মনোযোগ দিতে পারে সরকার, যার ফলে শুরু হবে মানুষের দুর্ভোগ, যা রূপ নিতে পারে বিক্ষোভে।

এসব পরিস্থিতির কারণেই সংঘাত বৃদ্ধি করতে ইরানের আগ্রহ কমছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, চরমপন্থিরা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতকেই বেছে নিতে পারে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায়, ইরান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ ধরণের অর্থনীতি সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হয়েছে। রাষ্ট্র এখানে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আমদানিপণ্যের বিকল্প হিসেবে স্থানীয় উৎপাদন শুরু করেছে।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই কৌশল খুব কার্যকর হয়নি। বরং, এতে ইরানের বাজেট ও ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর চাপ পড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এতে করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতেই শেষ পর্যন্ত কট্টরপন্থি অংশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াইকে বেছে নিতে পারে। এর ফলে জাতীয়বাদী মনোভাবও তুঙ্গে উঠবে, যা শাসকগোষ্ঠীর জন্য সুবিধাজনক হবে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ইয়াসমিন মাথের বলেন, ‘ইরানে অনেকেই বলবে যে, আমরা পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখতে পারবো না, যদি না কোনো যুদ্ধ হয়। আর ইরানি সরকারের জন্য, সংকট সবসময়ই ভালো জিনিস। সবসময়ই ভালো জিনিস ছিল। দেশের সব ধরণের অর্থনৈতিক সমস্যা আপনি নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের ওপর চাপাতে পারবেন। গত কয়েক বছর ধরে, অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরাতেই নানা ধরণের বিপজ্জনক কৌশল হাতে নিয়েছে ইরান।’

এছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যার চেয়েও ইরানি নেতারা যে জিনিসকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন, তাহলো, তাদের নিজেদের অস্তিত্ব। যদি বাইরের কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা সহজ হয়, তাহলে অর্থনৈতিক দুর্দশাকে মেনে নিতেও তাদের আপত্তি থাকবে না।
লন্ডনের চ্যাথাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক উপপরিচালক সানাম ভাকিল বলেন, ‘মানুষকে খাটিয়ে হলেও ক্ষমতায় থাকতে চায় চরমপন্থিরা। ইরান শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সিদ্ধান্ত নেয় না।’

(নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত। সংক্ষেপিত।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status