ঢাকা সিটি নির্বাচন- ২০২০

চ্যালেঞ্জের ভোট

আলতাফ হোসাইন

৫ জানুয়ারি ২০২০, রবিবার, ৭:৩২ পূর্বাহ্ন

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিয়ে বিএনপি দোটানায়। নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচন কমিশনের উপর আস্থা রাখতে পারছে না দলটি। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের ওপর শতভাগ আস্থার পাশাপাশি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন। এমন দোলাচলেই আগামী ৩০শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। উত্তরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতিকুল ইসলামের বিপরীতে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। দক্ষিণে শেখ ফজলে নূর তাপসের বিপরীতে লড়ছেন ইশরাক হোসেন। তবে নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের চেয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কিনা- তা নিয়েই বেশি ভাবনা বিএনপির। জাতীয় নির্বাচন ও এর আগের সিটি নির্বাচনগুলোতে অনিয়ম-কারচূপির অভিযোগ ছিলো দলটির। পূর্ব অভিজ্ঞতার জেরে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না তারা। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে আস্থাহীনতায় ভুগছে বিএনপি নেতারা। বিএনপি নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এত অভিযোগ আর অনাস্থার মধ্যেও নির্বাচনে অংশ নেয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে- কর্মীদের চাঙ্গা করা, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জয়ী হয়ে জনপ্রিয়তা প্রমাণ করা এবং কারচুপি করে হারিয়ে দিলে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের স্বরূপ উন্মোচন করা। একইসঙ্গে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না মর্মে তাদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমান করবে বিএনপি। সেই সঙ্গে এই নির্বাচনকে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জেল থেকে মুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবেও দেখছেন তারা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবরই বলে আসছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ও এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। শুধু গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তারা। ভোট সুষ্ঠু হলে বিএনপির প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়ী হবেন। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না জেনেও বিএনপি কেন নির্বাচণে অংশ নিচ্ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি মহাসচিব বলছেন, ২০১৮ সালে নির্বাচনে গিয়েছিলাম এই কথা প্রমাণ করতে যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গিয়ে আমরা ভুল করিনি। বর্তমান সরকার ও ইলেকশন কমিশনের অধীনে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, সেটা প্রমাণ করার জন্যই গেছি। আজকেও প্রশ্ন আসছে, বিএনপি সিটি নির্বাচনে কেন যাচ্ছে? আমরা বার বার প্রমাণ করতে চাই, আওয়ামী লীগের আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। এই নির্বাচনকে লোক দেখানো নির্বাচন মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলছেন, এই নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। এই নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করছি। কারণ, আমরা জনগণের একটি রাজনৈতিক দল 
। আমরা মনে করি, যদি দেশের মানুষ ভোট দিতে পারে এই সিটি নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজিত করবে। কিন্তু সেটা তারা করতে দেবে না, এটা আমরা জানি। গণতন্ত্রের যে মৃত্যু ঘটেছে এই দেশে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার আবারও প্রমাণ করবে।
অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন নির্বাচনে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে বলছেন, যত বাধাই আসুক, কোন কিছুতেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবো না। ইশরাক হোসেন বলেন, নির্বাচন নিয়ে যত ভয়-ভীতি, অত্যাচার নির্যাতনই করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকব। সরকারি দলের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, যত ভয় ভীতি দেখাচ্ছেন, মনোবল তত শক্ত হচ্ছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন হারানো আস্থা ফিরে পেতে পারে বলেও মনে করেন ইশরাক। এই নির্বাচনকে তিনি দেখছেন ইসির আস্থা ফিরে পাওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ হিসেবে। তবে ভোট নিরপেক্ষ হবে কিনা- তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিএনপির দুই প্রার্থীর। উত্তরের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সেই সংশয় প্রকাশ করে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকার কথা জানিয়েছেন। তাবিথ মনে করেন, নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হবে কিনা- এটা নিয়ে সন্দেহ আছে। সন্দেহ শুধু আমাদের একার নয়, সাধারণ জনগণের অনেক প্রশ্ন আছে, তারা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন কিনা? নির্বাচন যদিও সুষ্ঠু হবে না, তবুও আমরা গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা রেখে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি।
অন্যদিকে দুই সিটিতিে আওয়ামী লীগের মেয়র পদে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নেতার প্রার্থীতা চূড়ান্ত হয়েছে। জয় নিয়ে শত ভাগ আস্থা রয়েছে দলটির। নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়া নিয়ে বিএনপির নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে বলছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরেপেক্ষ হবে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করে আসছেন তারা। ইভিএম নিয়ে নানান মহল থেকে প্রশ্ন উঠলেও তার স্বপক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে আসছেন তারা। সবমিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর শতভাগ আস্থার পাশাপাশি নির্বাচনে জয় নিয়েও বিশ্বাস রয়েছে আওয়ামী লীগের। শুরু থেকেই তারা এই নির্বাচন নিয়ে পজিটিভ কথাবার্তা বলে আসছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে তারা নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। বিএনপি নেতাদের নানা অভিযোগে তিনি নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে বলে তাদের আশ্বস্ত করেছেন। এই নির্বাচন তাদের দলের জন্য চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমরা একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে আশাবাদি। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস তিনি দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা একটি ভালো নির্বাচন করতে চাই। নির্বাচনের যেটাই ফল হোক মেনে নেবো। ইভিএম পদ্ধতিতে বাংলাদেশে যেসব নির্বাচন হয়েছে এর মধ্যে বেশিরভাগ বিএনপি জিতেছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ইভিএম হলে তাদের আরও বেশি করে জেতার সম্ভাবনা থাকতে পারে। নির্বাচনে ইভিএম ক্রটিযুক্ত মনে করার কোনো কারণ নেই। এর আগে আমাদের দেশে ইভিএম নিয়ে কোনো ক্রুটি ধরা পড়েনি। এ পদ্ধতি দিয়ে ক্রুটিমুক্ত নির্বাচন করা সম্ভব। এনিয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই বলে জানান তিনি। একই সঙ্গে নির্বাচনে জয় নিয়েও শতভাগ আশাবাদি তারা। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস আগে থেকেই দলটির পছন্দের তালিকায় ছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরেই দলের পর্যবেক্ষণে ছিলেন ঢাকা-১০ আসন থেকে নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য। শতভাগ জয়ের আশাতেই সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সেইসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উন্নয়নের পরিকল্পনা এবং জনসেবা নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি। নির্বাচিত হলে প্রথম ৯০ দিনেই সিটির মৌলিক সেবাগুলো নিশ্চিত করারও ঘোষণা দেন তিনি। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত উত্তরের মেয়র প্রার্থী আতিকুল বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করছি। যেকোনো নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব দল অংশ নিচ্ছে। তাই এটি সুন্দর নির্বাচন হবে বলে আমরা আশা করি। জয়ের ব্যাপারে আশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, নৌকার কোনো ব্যাকগিয়ার নেই। আমরা জয়ের আশাবাদী।
আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন পজিটিভ ভাবনাতেও নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে বিএনপি নেতাদের মনে রয়েছে সংশয়, অনাস্থা ও নানা অভিযোগ। তবে সার্বিক বিবেচনায় এবারের সিটি নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।


 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status