মত-মতান্তর

রাজাকার তালিকা এবং কিছু তিক্ত কথা

লামিউর রায়হান

১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:৩৩ অপরাহ্ন

বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে ‘মুক্তিযুদ্ধ’। বাঙালির আবেগ, চিন্তা, রাজনীতি, দর্শন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং সর্বোপরি তার সংস্কৃতির সঙ্গেই ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত- এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আবেগ এবং গর্বের প্রতিচ্ছবি আর নিঃসন্দেহে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান- যারা জীবন দিয়ে, সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের  কেবল স্বাধীনতা-ই দিয়ে যান নি বরং চলার পথও দেখিয়ে  গেছেন। অপরদিকে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী, নিজের ভাইয়ের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস গোষ্ঠী গণধিক্কারের পাত্র এটাও সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর কাছাকাছি পৌঁছে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৈরীকৃত রাজাকারের তালিকা নিয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ নির্মোহভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

গত ১৫ই ডিসেম্বর, ২০১৯ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যারা রাজাকার ছিলেন তাদের একটি তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। আমি অত্যন্দ আশাবাদী ছিলাম এই জন্য যে, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে হলেও অন্তত একটা তালিকা তো আমরা পেতে যাচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরীর প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না, কারণ দেশের অধিকাংশ মানুষই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং কোনো না  কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বরং অল্প কিছু  বেঈমান রাজাকারদের তালিকা তৈরী করতে পারলেই উত্তম।

প্রথমত, তালিকাটিকে আমি খুব হালকাভাবে নিতে চাই না এই বিবেচনায় যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, ‘তালিকা আমরা প্রণয়ন করি নাই। প্রকাশ করেছি। তালিকা আমরা পেয়েছি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে, তার দাড়ি কমা সেমিকোলন- কিছুই আমরা পরিবর্তন করি নাই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী যেভাবে তালিকা করেছিলো, সেটাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের দিলে আমরা সেটাই প্রকাশ করেছি।’ (বিবিসি বাংলা, ১৭ই ডিসেম্বর, ২০১৮)। খুব সহজ ব্যাখ্যা।  যেহেতু তালিকাটি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের করা, কাজেই তাতে রাজনৈতিক  কোনো কারণ থাকার  যৌক্তিকতা কম বরং কোনো না  কোনোভাবে তালিকায় থাকা  লোকগুলো তাদের সমর্থন করেছে, তাদের হয়ে ভূমিকা  রেখেছে অফিশিয়াল ডকুমেন্টের ভিত্তিতে- এটা বললে অত্যুক্তি হবে না বলেই মনে করি।

দ্বিতীয়ত, এই তালিকা দেখে সঙ্গত কারণেই মানুষের চোখ কপালে উঠে গেছে। এই তালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি সবাইকে অবাক করেছে সেটি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধীদের বিচারের জন্য তৈরিকৃত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপুকে রাজাকার তালিকায় রাখা হয়েছে। এটি কেবল সাংঘর্ষিকই নয় বরং পুরো বিচার প্রক্রিয়া তথা বিচার বিভাগ এবং সরকারকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। অনেক গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তালিকা নিয়ে। কেবল ওনার বিষয়টিই যদি আমরা কেস স্টাডি হিসেবে নিই, তবে আসুন কিছু বিষয় পর্যালোচনা করি। উনি রাজাকার ছিলেন, নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার বিশ্লেষণ আমি করতে চাই না বরং এই তালিকার ভিত্তিতেই কয়েকটি বিষয় আলোকপাত করতে চাই।

ক) উনি যদি রাজাকারই হবেন, তাহলে ওনার মতো একজনকে দিয়ে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিচার প্রক্রিয়া কেন পরিচালনা করা হলো? এই তালিকা তো আসমান থেকে হঠাৎ নাজিল হয়নি বরং ৪৮ বছর ধরেই সরকারের নথিতে বিদ্যমান। মন্তব্যের ঘরে দেয়া আছে যে, জেলা কমিটি সুপারিশ করেছে উনিসহ কয়েকজনের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য। অদ্যাবধি এটিতো করা হয়নি বরং তালিকায় ওনার নাম সংযুক্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার তা প্রকাশ করেছে। এতে এমন ভয়াবহ এবং হাস্যকর কনফ্লিক্ট তৈরী হয়েছে যেটা কোনো যুক্তিতেই ব্যাখ্যা করা যায় না।

খ) উনি যদি সত্যি রাজাকার না হোন, তবে এতো বছর পরেও এতো আয়োজন করে যে তালিকা সরকার প্রকাশ করেছে তার দায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে জনাব আরিফের কাছে ব্যাক্তিগতভাবে ক্ষমা চেয়ে জাতির কাছে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চেয়ে ইমিডিয়েট পদত্যাগ না করার যৌক্তিক কোনো কারণ আছে কি?

তৃতীয়ত, তালিকায় থাকা আরও উল্লেখযোগ্য কিছু নাম আছে যারা এমনকি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের সকল সুবিধা ভোগ করেছেন সুদীর্ঘকাল। এটা যদি সত্যি হয় তবে এতদিন যা হয়েছে তার দায় কার? আর যদি মিথ্যে হয়, তাহলে এতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এমন জঘন্য কাজ করার কারণে পুরো মন্ত্রীসভাই তো পদত্যাগ করা উচিত! রাষ্ট্রের-জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে, এতো আয়োজন করে উনারা যাচাই-বাছাই না করেই কপি পেস্ট করে পুরো বিষয়টিকে হাস্যকর বানিয়ে ফেলার অপরাধ তো রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ার কথা।

চতুর্থত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি গণআন্দোলন ছিলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিজয়ের এতো বছর পরেও আমরা স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানতে পারিনি অনেকাংশে। যারা যখন ক্ষমতায় ছিলো, তারা তাদের ইচ্ছেমতো স্বাধীনতার ইতিহাস লিখেছে। একপক্ষ আরেকপক্ষকে কনফিডেন্সে না নিয়ে বরং বিষোদগার করেছে। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সামগ্রিকভাবে কার কি ভূমিকা ছিলো সেগুলো নির্মোহভাবে কনসার্নে না নিয়ে বরং শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছে, মিথ্যে ভুলে ভরা ইতিহাস লিখা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা হয়েছে কেবল হীন স্বার্থে, অনেকক্ষেত্রেই এক্সাজারেশন করা হয়েছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এতো স্পর্শকাতর একটা কমপ্লিকেটেড ঘটনাপ্রবাহকে এতো সহজে সরলীকরণ করা যায়? জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই এই বিষয়গুলো পুনর্বার ভাববার দাবি রাখে, বারংবার ক্রস চেক করার প্রয়োজনীয়তা থেকে যায়।

পঞ্চমত, ক্ষমতাসীনরা স্বীকার না করলেও দেশ একটি জটিল সময় পার করছে, যার সঙ্গে আগামী দিনের উপমহাদেশের রাজনীতি এবং জিওপলিটিক্যাল মুভমেন্ট জড়িত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এনআরসি বিষয়ক আইন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে মানবতার বিরুদ্ধে একধরণের যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যার প্রেক্ষিতে পুরো ভারতজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই এটি আমাদের ডিপ কনসার্ন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই ধরণের একটি বিতর্কিত তালিকা প্রকাশ করে মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার পেছনে সরকারের কি উদ্দেশ্য আছে সেটিও পরিস্কার নয়।

ষষ্ঠত, এই তালিকা আমাদের চিন্তার রাজ্যে একটা বড় ধরণের খোরাক যোগাবে এটা আমার বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত সোল এজেন্ট বলে যারা নিজেদের দাবি করে, চেতনার কথা বলে যারা ভ-ামি করে, পুরো জাতিকে মিথ্যে ব্যাখ্যা দিয়ে রাজনীতি করে তাদের ওপর এই তালিকা একটি চরম চপেটাঘাত। কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠী বা আদর্শ অথবা ধর্ম যে মুক্তিযুদ্ধের একক বিরোধিতা করেছিলো এমন নিম্নমানের ব্যাখ্যাকে এই তালিকা চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। আমাদের প্রচুর স্টাডি করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে, অনেক অনেক চেষ্টা করতে হবে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানার।

সর্বশেষ, এই তালিকা হয়তো স্থগিত হতে পারে বা নতুন করে সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে তবে একথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যেভাবে ক্ষমতাসীনরা মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে তাদের ক্রেডিবিলিটি হারিয়েছে, আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, বার বার নোংরা খেলা খেলবার অপপ্রয়াস চালিয়েছে, তাদের চিন্তার দৈন্যতা প্রকাশ করেছে এবং নিজেদের চরম অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে, সর্বোপরি গণমানুষের বিশ্বাস নষ্ট করে মনের অজান্তেই তাদের চোখ খুলে দিয়েছে তাতে তাদের তৈরী আর কোনো তালিকাই সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না।

অতীতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়েও বিস্তর বিতর্ক উঠেছে, দফায় দফায় ভূয়া তালিকা তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে, যার সুবিধাভোগী অনেক আমলা, রাজনীতিবিদ। এসবের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়েছে যেখানে ক্ষমতাসীনদের মদদ রয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল ক্ষমতার প্রয়োজনে রাজাকারদের সঙ্গে রেখেছে, রাজনীতি করেছে, ভাগ বাটোয়ারা করে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধকে সবাই নিজের প্রয়োজনে বিজনেস বানিয়ে ছেড়েছে। হুটহাট করে যাকে তাকে মুক্তিযোদ্ধা আবার যাকে তাকে রাজাকার বানিয়ে ফেলার মতো ঘৃণ্য খেলা থেকে বিরত হওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট সকলের।

পরিশেষে, সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে জোর দাবি জানাই, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে হাসি-তামাশা বন্ধ করুন। হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয় বরং সত্যিকার অর্থে রাজাকারদের তালিকা করুন সকলকে কনফিডেন্সে নিয়ে। আপনাদের প্রকাশিত তালিকা যদি সত্যি হয়, তবে এটিতেই অটল থাকুন, ইতিহাসকে ইতিহাসের আপন গতিতে চলতে দিন। আর যদি ভুল থাকে তবে ক্ষমা চান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, জাতির কাছে, সময় নিয়ে সকল কন্টেন্ট নির্মোহভাবে এনালাইসিস করে তালিকা তৈরী করুন, জনসম্মুখে প্রকাশ করুন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। জনগণ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, অন্তত নিজেরা একটা ভালো কাজ করে বিবেকের কাছে পরিস্কার থাকুন, বাকিটা ইতিহাস বিচার করবে।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আবেগের জায়গা, তবে ইতিহাসকে কেবল আবেগ নয় বরং বিবেক দিয়েই বিচার করার মানসিকতা আমাদের গ্রো করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করুক বাংলার জনগণ, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি এবং স্পিরিট বাস্তবায়িত হোক সর্বত্র এই প্রত্যাশা রইলো। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের হৃদয়ের মনিকোঠায় অবস্থান করুন চিরকাল, দূর হোক ভেদাভেদ ও দূরত্ব, দেশ এবং মানুষ বাঁচাতে ঐক্যের দ্বার উন্মোচিত হোক সর্বাগ্রে।

লেখক: গবেষক, কিয়োতো ইউনিভার্সিটি, জাপান
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status