মন ভালো করা খবর

একা পথেই হাঁটছেন এলিজা

কাজল ঘোষ

১৬ ডিসেম্বর ২০১৯, সোমবার, ১:৫৫ পূর্বাহ্ন

পথও একা, আমিও একা। কথাটি পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা ভ্রামণিক অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর। আর এই একা পথেই হাঁটছেন এলিজা। ঘুরছেন দেশে দেশে। তার এই হাঁটা শুরু ১৯৯৯ সাল থেকে। তারপর কেটে গেছে ২০ বছর। নানান আর্থিক কষ্ট সয়েও শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে অর্থ জমিয়ে নতুন নতুন দেশকে জানতে ছুটে যাচ্ছেন। আর এই ছুটে যাওয়া দেশের তালিকায় যুক্ত করেছেন ৪৯টি দেশের নাম। তবে তার এই ভ্রমণ খাওয়া-দাওয়া, শপিং কিংবা সিনেমা দেখার জন্য নয়। প্রতিটি দেশেই তিনি ছুটছেন ঐতিহ্যের অন্বেষণে, নেপথ্যের ইতিহাসের সন্ধানে। আর নিজ দেশের ৬৪ জেলার ঐতিহ্য বাঁচাতে করছেন তথ্য সংগ্রহ। তা ডিজিটাল মাধ্যমে ধারণ করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন দুনিয়াজুড়ে। তার টার্গেট একটাই। ঐতিহ্যের মাধ্যমে দেশকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরা। পুরো নাম এলিজা বিনতে এলাহি। সংসার, শিক্ষকতা আর ভ্রমণ এই তিনে মিলে লড়ছেন হেরিটেজ সংরক্ষণে সচেতনতা গড়তে। স্বামী ব্যবসায়ী ফাইয়াজ আলম খান আর একমাত্র সন্তান নবীনেওয়াজ খাানের সহযোগিতায় এলিজা এগিয়ে যাচ্ছেন।

এলিজার অভিব্যক্তিও সারল্যে ভরা। ছোট থেকেই ইতিহাসপ্রেমী, প্রত্নতত্ত্ব অনুরাগী। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো তৈরির পেছনের মানুষগুলোর ভাবনা তার কারিগররা আমাকে শুধু মানুষের সীমাহীন ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই ইট পাথরের ভবনের ভেতরের সৃজনী শক্তি থেকে আমি এক ধরনের শক্তি অনুভব করি। আমার মনে হয় মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই,  শুধু স্বপ্ন দেখতে হবে। এই সব ঐতিহ্যের পেছনে যখন প্রথমদিকে ছুটেছি তখন মানুষ হাসতো। বলতো, ভাঙা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এত খুশি হওয়ার কি আছে। সত্যিই তাই, এলিজা যুক্ত করেন, আমি আসলে যেখানেই গিয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই এলাকার ইতিহাস সংগ্রাহকদের খুঁজে বের করে কথা বলি। এটাই আমার আনন্দ। আমার নেশা হচ্ছে, ভ্রমণ আর ইতিহাসের বই সংগ্রহ।   

প্রকৃতির মাঝে মানুষকে খুঁজে পান না এলিজা। কিন্তু স্থাপনায় মানুষের চিন্তা ও মননশীলতাকে খুঁজে পান। স্থাপনায় মানুষের চিন্তার প্রতিফলন তাকে বিস্মিত করে। এলিজার আক্ষেপ বর্তমান সময়ে আমরা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টের গণ্ডিতে আটকে গেছি। অথচ, আগের জমিদারদের তৈরি স্থাপনা দেখলে বোঝা যায় তাদের চিন্তার বিশালত্ব কতখানি।

যেভাবে শুরু করলেন?
একেবারে তিন বছর বয়স থেকেই ভ্রমণ স্মৃতি মনে আছে। ঢাকা থেকে ট্রেনে যখন জামালপুর যেতাম তখন থেকেই তা চোখে ভাসে। আর অনানুষ্ঠানিক বিশ্ব ভ্রমণ শুরু করেছি ১৯৯৯ সালে। জীবন উপভোগের একটি মাধ্যম মনে হয় আমার কাছে ভ্রমণ। রহস্যময় এই পৃথিবীর স্বাদ এই স্বল্প সময়ের জীবনে দেখার বাসনা থেকেই ভ্রমণ শুরু। তবে দেশের বাইরে যাওয়ার আগেই নিজের দেশ দেখেছি উদ্দেশ্যহীনভাবে।

আমি কোনো গবেষক বা এক্সপার্ট নই। ভ্রমণ আমার নেশা, ভালোবাসা। আর এই ভ্রমণের উপাত্ত ইতিহাস দুটোই আমার ভালোবাসার বিষয়। সেই জায়গা থেকেই আমার উচ্চতর পড়াশোনায় যুক্ত করেছি বাংলাদেশ ট্যুরিজম। বাংলাদেশ ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করি ২০০৮ সালে। প্রথম গবেষণাপত্র তৈরি করি, 'Publici“ing Tourism : opportunity and challenges in the context of Bangladesh.' আর দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালে নেদারল্যান্ডসে ‘A communication plan for Bangladesh Govt. to promote Bangladesh as a Global Tourist Destination .’ দুটি গবেষণা পত্রেই আমি উল্লেখ করেছি কি কি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে বাংলাদেশকে একটি বিশ্ব পর্যটনের দেশ বানানোর জন্য।

আর কি কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?
২০১৬ সালে শুরু করলাম আমার ব্যক্তিগত প্রজেক্ট, QUEST..a heritage journey of Bangladesh, এটি মূলত দেশজুড়ে হেরিটেজ ট্যুরিজম বিকাশের জন্য। ঢাকার বলধা গার্ডেন দিয়ে শুরু করেছিলাম। সময়টি ছিল ২০১৬ সালের ১৭ই মে, শেষ করেছি চলতি বছরের ২৮শে আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার মাধ্যমে।

আমার পড়াশুনার বিষয় কখনো ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ব ছিল না। নিজের ইচ্ছার তাগিদে আমি আমার প্রফেসরদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমার শখের বিষয়কে পড়াশুনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছি। আমার কাজের সঙ্গে সবসময় বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছি। শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে আমি এখন পর্যন্ত ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও জাপানে  ৮টি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে যোগ দিয়েছি। সেখানে বাংলাদেশের ট্যুরিজম এবং বেগম রোকেয়ার অবদানের কথা তুলে ধরেছি।

হেরিটেজকে বেছে নিলেন কেন?
বাংলাদেশে প্রত্নতত্ত্ব, ইতিহাস কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য কোনো কিছুর কমতি নেই। শুধু ঘাটতি হচ্ছে সেই ঐতিহ্যকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা। আমরা সমৃদ্ধ ছিলাম, আছি, নয়তো যুগে যুগে বিশ্ব পর্যটকরা কেনই আমাদের দেশে আসবেন বা রচনা করবেন ভ্রমণগাঁথা। আমাদের প্রাচীন ইতিহাস আমরা জানতে পারি তাদের লেখনি থেকেই। অনেক আগেই বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন, ইতিহাস রক্ষায় বা লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের উদাসীনতা। সে কথাই হয়তো সত্য। আর সেই পরিস্থিতি মাথায় রেখেই হেরিটেজের পেছনে ছুটছি।

ভ্রমণের নেশায় পেলো কি করে?
একটি নতুন শহরে ভ্রমণ (দেশে অথবা বিদেশে) মানেই নতুন কিছু শেখা, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়, নতুন কিছু জানা। বাংলাদেশে ৬৪ জেলা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, যা কিছু দেখেছি, জেনেছি, মানুষের সঙ্গে মিশেছি সব কিছু যদি লিপিবদ্ধ করতে চাই, তাহলে এক জীবনে সম্ভব হবে না। ভ্রমণ আমার কাছে স্রেফ ঘুরে বেড়ানো নয়, বরং ভ্রমণ মানে ইতিহাস, প্রেরণা ঐতিহ্য, শক্তি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, আত্মপরিচয়, আর শেকড়ের সন্ধানে এক বিনির্মাণের যাত্রা।
২০ বছরের বিশ্ব ভ্রমণের যাত্রায় আমার নিজেকে সত্যিকার ট্রাভেলার মনে হয়েছে যখন আমি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় কোনায় কোনায় গিয়েছি। আমার দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মানুষ আমাকে যা আনন্দ দিয়েছে পৃথিবীর বড় বড় দেশ তা দিতে পারেনি। আমি দেখেছি গর্ব করার মতো বিশ্বমানের স্থাপনা আমাদেরও রয়েছে। প্রয়োজন শুধু সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচার প্রচারণা।

এলিজার বিচিত্র অভিজ্ঞতা  
ভ্রমণ অভিজ্ঞতা একেক স্থানে একেক রকম। দেশের ভেতরের অভিযাত্রা বাইরের সঙ্গে মেলানো যাবে না। যখন নিজ দেশে ভ্রমণ করি তখন একরকম অভিজ্ঞতা হয় কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা। আর এই অভিজ্ঞতাগুলো অর্জন করি সে দেশের মানুষের আচার আচরণ, সংস্কৃতি থেকে। অনেক সময় দেখা যায় যখন নতুন দেশে যাচ্ছি তখন তারা একজন ভিনদেশি মানুষকে কীভাবে গ্রহণ করছে তার ওপরও।  সে ক্ষেত্রেও দক্ষিণ এশিয়া, মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ একরকম, আবার ইউরোপের অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্নরকম।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এলিজা বলেন, কোনো দেশে ট্যুরিস্ট হিসেবে যাওয়া আর বসবাস করার জন্য যাওয়ার মধ্যেও বিস্তর ফারাক রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ট্যুরিস্টদের সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করে। ট্যুরিস্টদের সেবা প্রদান  তাদের সংস্কৃতির অংশ।

ইউরোপ বেড়াতে গিয়ে রাস্তায় যখন কোনো বাংলাদেশি পেশাজীবী দেখেছি অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করেছে। ইতালির রোমে অনেক বাংলাদেশি চোখে পড়েছে। তবে তাদের বেশির ভাগই ফুটপাথে পসরা সাজিয়ে বসে আছে দেখে মন খারাপ লাগতো। গ্রিসেও প্রচুর দেশের মানুষ চোখে পড়েছে। বেলজিয়ামে  কাউকে কাউকে স্যুভেনির শপ খুলে ব্যবসা করতে দেখেছি। নেদারল্যান্ডসের একটি শহরে স্যুভেনির শপে এক ডাচ্ নাগরিককে দেখেছি একটি রিকশা দিয়ে তার শপ সাজিয়েছে। তখন দারুণ অনুভূতি হয়েছে। সেই ডাচ্ নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ব্যবসা করতে। কিন্তু ফিরে যাবার সময় জাহাজে করে একটি রিকশা সঙ্গে নিয়ে ফেরেন।  
নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগে গিয়ে এক মজার অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হয়েছি সেটা ২০১৮ সালের ঘটনা। সময়টা শীতকাল হবে। আমি উচ্চতর পড়াশোনা করতে সেখানে ছিলাম এক বছরের বেশি। আমার বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। অর্ধেক পথ এলে একটা লম্বা রাস্তা। রাস্তার এ মাথা  থেকে ও মাথা অবধি দেখা যায়।

সকালবেলা রাস্তাটি জনমানবশূন্য থাকে। মাঝে মধ্যে দুয়েকজন সাইকেল আরোহী এবং বয়স্ক লোক চোখে পড়ে যারা কুকুর নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে আসেন। আমি দূর থেকে দেখছিলাম একজন বয়স্ক ভদ্রলোক নিজে ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না, লাঠিতে ভড় করে হাঁটছেন। কিছুটা কাছে এগুতেই  দেখলাম তার দুটো কুকুরের মধ্যে একটি কুকুর রাস্তার উপর প্রাকৃতিক কাজ সারছে। ভদ্রলোক তা টিস্যুতে তুলে একটি পলিথিন ব্যাগে নিলেন। এরপর সেই পলিথিন ব্যাগ তার পকেটে রাখলেন। এই দৃশ্যটি আমার মনে অনেক দাগ কাটলো। তাদের দেশে প্রেমের মাত্রাটা কতটুকু তা অনুধাবনের চেষ্টা করলাম। এ রকম ঘটনার মুখোমুখি অনেক সময়ই হয়েছি হেগের পথেঘাটে।  

পরক্ষণেই আমার মনে হলো, প্রত্যেকটি জাতির অন্ধকার যুগ আছে। ডাচ্দেরও আছে। তাদের অনেক অনাচারের কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু ঠিক কবে থেকে তারা সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করা শিখলো? যিনি আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে ধাক্কা দিলেন সেই ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ সত্তুর হবে। এ ধরনের অভ্যাস হঠাৎ রপ্ত করা যায় না। বহুদিনের অনুশীলনের ফল এটি। কোন মন্ত্র বা ফর্মুলা পেলে একটি ‘জলদস্যু’ জাতি জনমানবহীন রাস্তায় এমন নাগরিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। তখন প্লেটোর একটি কথা মনে হয়েছিল। প্লেটো বলেছিলেন, ‘নিজের দায়িত্ব নিজে সঠিকভাবে পালন করাই দেশপ্রেম।’

কতদূর যেতে চান?
বিশ্ব ভ্রমণের কথা যদি বলেন দেখতে চাই পুরো বিশ্ব। মৃত্যু অবধি ভ্রমণ করতে চাই। আর বাংলাদেশকে তুলে ধরতে চাই, হেরিটেজ ট্যুরিজমের এক অনন্য স্থান হিসেবে বিশ্ব পর্যটকদের কাছে। বর্তমানে কাজ করছি বছরে একদিন যেন হেরিটেজ ট্যুরিজম ডে হিসেবে পালন করা হয় তা নিয়ে। কর্র্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি। অপেক্ষা, কি দাঁড়ায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status