এক্সক্লুসিভ

শহীদ লিলু মিয়ার রণাঙ্গনের গল্প

কুলিয়ারচর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি

১৬ ডিসেম্বর ২০১৯, সোমবার, ৮:৫৫ পূর্বাহ্ন

মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজের জীবন আত্মোৎসর্গকারী বীর সেনানী শহীদ ল্যান্স নায়েক লিলু মিয়া বীর বিক্রম। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সশস্ত্র লড়ার করে নিজের জীবনের বিনিময়ে শত্রু মুক্ত করে গেছেন আমাদের দেশ, এনে দিয়েছেন স্বাধীনতার লাল সূর্য। মুক্তিযোদ্ধা লিলু মিয়া ১৯৭১ সালে দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের ৯ উইংয়ে (বর্তমানে ব্যাটালিয়ন) কর্মরত ছিলেন। ২৬শে মার্চ সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতার চেতনায় ঠাকুরগাঁও শহরের রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। তাঁরা সড়কে ব্যারিকেড দেয় এবং বাঙালি ইপিআরদের আহবান জানায় তাদের সাঙ্গে যোগ দিতে। একদিকে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর জনতার আহবান, অন্যদিকে নিজস্ব বাহিনীর শৃঙ্খলার আর অনুশাসন। ঠাকুরগাঁও উইংয়ের বাঙালি ইপিআর সেনারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কারণ, তখন ওই উইং হেডকোয়ার্টার্সে ছিল বিপুল সংখ্যক (১২০-১২৫ জনের অর্ধিক) অবাঙালি সেনা। এ ছাড়া সেখানে ছিল সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য। শেষ পর্যন্ত দেশ মাতৃকার আহবানেরই সাড়া দেন ঠাকুরগাঁও উইংয়ের বাঙালি ইপিআর সেনারা। ২৮শে মার্চ রাতে (তখন ঘাড়ির কাঁটা অনুসারে ২৯শে মার্চ) লিলু মিয়াসহ বাঙালি ইপিআর সেনারা বিদ্রোহ করেন। উইংয়ে বাঙালি-অবাঙালি ইপিআরদের মাধ্যে ৩০শে মার্চ পর্যন্ত সশস্ত্র লড়াই হয়। এই সংঘর্ষে বেশির ভাগ অবাঙালি ইপিআর ও পাকিস্তানি সেনা (প্রায় ১১৫ জন) নিহত হয়।
এরপর তৎকালীন ইপিআরের বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতার যুদ্ধে। তাঁরা বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে অবস্থান নেন। একটি দল ভাতগাঁও (ঠাকুরগাঁও থেকে ২৩ মাইল আগে), একটি দেবীগঞ্জে, একটি দল শিবগঞ্জে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেন। এছাড়া ঠাকুগাঁও-সৈয়দপুরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী বিভিন্ন সড়কের খানসামা, জয়গঞ্জ ও ঝাড়বাতিতেও তাঁরা প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযোদ্ধাদের এসব প্রতিরক্ষার একটি ইউনিটের সঙ্গে আরেকটি ইউনিটের ফিল্ড টেলিফোন বা ওয়্যারলেস যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। একমাত্র রানারই ছিল তখন যোগাযোগের মাধ্যম। কখনো কখনো এ রানার কাজের দায়িত দেয়া হয় নির্ভীক, অকুতোভয় ও কৌশলী লিলু মিয়াকে। তিনি যুদ্ধের পাশাপাশি এই দায়িত্বও সাহসিকতার সঙ্গে তখন পালন করেন।
এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন লিলু মিয়া এই দায়িত্ব পালনকালে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে এক প্রতিরক্ষা ইউনিট থেকে আরেক প্রতিরক্ষায় যাচ্ছিলেন। পথে দিনাজপুর-সৈয়দপুর সড়কের ১০ মাইল নামক স্থানে তিনি আক্রান্ত হন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে। ১০ মাইলেও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রবল আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক দিন আগে অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে ওই প্রতিরক্ষা অবস্থান কৌশলগত কারণে ত্যাগ করেন।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের এক প্রতিরক্ষা থেকে আরেক প্রতিরক্ষায় খবর পৌঁছাতে হবে ওই এলাকা দিয়েই। ১০ মাইল এলাকায় আছে পাকিস্তানি সেনা। আকাশেও মাঝেমধ্যে চক্কড় দিয়ে বেড়ায় পাকিস্তানি হেলিকপ্টার। এই অবস্থায় খবর পৌঁছানোর এ গুরু দায়িত্ব পড়ে লিলু মিয়ার ওপর। কিন্তু তিনি এতে দামে যাননি। নির্ভয়ে এগিয়ে যান ওই এলাকা দিয়েই। কিন্তু সফল হতে পারেননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। নিভে যায় তাঁর জীবন প্রদীপ। শহীদ হন তিনি। শহীদ লিলু মিয়ার মরদেহ তাঁর সহযোদ্ধারা উদ্ধার করতে পারেননি। পরে তাঁর মরদেহ স্থানীয় গ্রামবাসী সেখানেই সমাধিস্থ করেন। সেই স্থান তাঁরা তখন পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে চিহ্নিত করে পর্যন্ত রাখতে পারেননি। স্বাধীনতার পর তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ খুঁজে পাননি। মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষত রানার হিসেবে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য শহীদ লিলু মিয়াকে মরণোত্তর “বীর বিক্রম” খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালে গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১১৪।
শহীদ লিলু মিয়ার পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতি ইউনিয়নের লোকমানখাঁর কান্দি গ্রামে। তিনি বিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম সোনা মিয়া, মা সাইরননেছা। স্ত্রী ললিতা বেগম। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। স্ত্রী ললিতা বেগম এখনো বেঁচে আছেন। স্বামীর পেনশন ভাতা পান তিনি। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলে ক্ষুদ্র ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status