প্রথম পাতা
সেমিনারে বক্তারা
বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আরো অনেক কিছু করতে হবে
স্টাফ রিপোর্টার
১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, রবিবার, ৯:১৬ পূর্বাহ্ন
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের এক যুগ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য আইনজীবী সমিতিকে শক্তিশালী ভূমিকা, বিচারককে ইনসাফ ও সদাচারী হওয়াসহ কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। এ ছাড়া, বিচারপ্রার্থীদের সুবিচার দিতে হলে, কে খুশি হলো আর কে অখুশি হলো, কে বিরাগভাজন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি বলবেন, অমুকে কি বলবেন এসব ভাবলে সুবিচার আসবে না। যেটি সঠিক, যেটি সত্য এবং ন্যায়সঙ্গত রায়ে সেসব বিষয়ে স্বাধীনভাবে তুলে ধরতে হবে। সর্বোপরি বক্তারা বিচার বিভাগ আর্থিকভাবে স্বাধীন না হলে বিচার বিভাগের এই পৃথক্করণ অনেকটাই মূল্যহীন হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন তারা। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্ত আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন। হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সংবিধান বিশ্লেষক মিজানুর রহমান খান। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবি সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
মূল প্রবন্ধে মিজানুর রহমান খান বলেন, বিচারবিভাগ পৃথকীকরণে আমাদের পলায়নপরতার অবসান ঘটুক। মাসদার হোসেন মামলার অর্জনকে পাথেয় করেই অবশ্য আমাদের পথ চলতে হবে। কিন্তু অধস্তন আদালতের পুরো একটি চ্যাপ্টার সাংবিধানিকভাব কোমায় আছে কিনা, সেটা একটা বড় জিজ্ঞাসা। এমনও হতে পারে, হয়তো অলক্ষ্যে এভাবে পড়ে আছে। কিন্তু এভাবে থাকা তো সমিচীন নয়। তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে গঠনমূলক সম্পর্ক সংবিধান সুরক্ষা এবং আইনের শাসনের কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। ১৯৯৯ সালের মাসদার হোসেন মামলার রায়ের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ওই রায়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল ৮টি। পরে তা আপিল বিভাগে হয় ১২টি। উভয় রায়ের ক্ষেত্রে আদালতের সামনে যে বিষয়টি নেয়া হয়নি, এমনকি পরেও কোনো মামলায় নেয়া হয়নি, সেটি হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামো হিসেবে যাচাই করা। এছাড়া, ছয় দফার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই দফাটির অর্জন আছে, আবার নেই। একটি জুডিশিয়াল পে কমিশন করার কথা বলা ছিল। সেই কমিশনের শেষ চেয়ারম্যান ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। কিন্তু তিনি অবসরে যাওয়ার পরে এটি আর কখনো গঠিত হয়েছে বলে জানা যায় না। সাত দফায় বলা হয়েছে, ১১৬ অনুচ্ছেদে অধীনে বিচারকদের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে মতের অমিল হলে সুপ্রিম কোর্টের মত প্রাইমেসি বা প্রাধান্য পাবে। কিন্তু এই দফা অর্জিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বিচারপতি মোস্তফা কামালের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, আমি একদিন তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, স্যার সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ মানতে সরকার বাধ্য? তিনি বলেছিলেন, না।
জাজমেন্টের সমালোচনা করলেই আদালত অবমাননা নয়
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, আমাদের দেশে জাজমেন্ট হয়। কিন্তু জাজমেন্টের পর কোনো সমালোচনা হয়না। জাজমেন্টের সমালোচনা করলেই কনটেমপট (আদালত অবমাননা) হবে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। একটি জাজমেন্টের চুলচেরা বিশ্লেষন ও গঠনমূলক সমালোচনা হতেই পারে। তিনি বলেন, বিচারপ্রার্থীদের সুবিচার দিতে হলে, কে খুশি হলো আর কে অখুশি হলো, কে বিরাগভাজন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি বলবেন, অমুকে কি বলবেন এসব ভাবলে সুবিচার আসবে না। যেটি সঠিক, যেটি সত্য এবং ন্যায় সঙ্গত রায়ে সেসব বিষয়ে স্বাধীনভাবে তুলে ধরতে হবে। এজন্য আমাদের চরিত্রে এবং অনুভূতিতে স্বাধীনতার বোধ থাকা প্রয়োজন, তাহলেই সত্যিকারের স্বাধীনতা আসবে।
বারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে সাবেক এই বিচারপতি বলেন, একটি শক্তিশালী বিচার ব্যাবস্থার জন্য বারকেও (আইনজীবী সমিতি) শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হয়। আইনজীবী সমিতি যদি আওয়ামী লীগ -বিএনপিতে বিভক্ত না হত এবং বার যদি ইউনাইটেড থাকতো তাহলে বিচার প্রার্থীদের সুবিচার পেতে আরো বেশি সহায়ক হতো। কেননা একটি ইউনাইটেড বার যদি না হয় তাহলে একটি শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা পাওয়া সম্ভব না। ন্যায় বিচার মানে মনিবের আনুগত্য নয় বরং আইনের আনুগত্য। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বার এবং বেঞ্চ-এর মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা করা প্রয়োজন।
বিচারবিভাগ আর্থিকভাবে স্বাধীন না হলে, পৃথকীকরই মূল্যহীন
সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন বলেন, নানামুখী প্রতিকূলতার মাঝে আমরা যে প্রত্যাশায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে স্বাক্ষর করেছিলাম তা হয়তো অনেকটাই কার্যকর হয়েছে। কিন্তু বিচারবিভাগ আর্থিকভাবে স্বাধীন না হলে এ পৃথকীকরণ অনেকটাই মূল্যহীন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা) এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা একটা গ্লোবাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো কর্তৃত্বপরায়ন সরকারের উদ্দেশ্য থাকে তার বিরুদ্ধে যেন কোনো রায় না আসে, যদিও বিচারের ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সদাচার জনগণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ নির্বাহী বিভাগের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, বর্তমানে বিচার বিভাগে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও আদালতের অত্যন্ত জটিল ব্যবস্থাপনা বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হওয়ার অন্তরায়। নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ একত্রিত হয়ে গেলে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই বিচার বিভাগের বাস্তবিক পৃথকীকরণের জন্য কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে নীতিমালা নেই
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবি সমিতির সাধারন সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমাদের বিচারবিভাগ বরাবরই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সবসময়ই সকল বিরোধী দল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল থেকে বঞ্ছিত হওয়ার অনেক কারণই রয়েছে। এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের কোনো আইনও নেই, নীতিমালাও নেই। যদিও নিম্ন আদালতের বিচারক হতে পরীক্ষায় অংশ নিতেও যোগ্যতা লাগে। সেখানে থার্ড ক্লাসধারীরা আবেদন করতে পারে না। অথচ উচ্চ আদালত হাইকোর্টে অনেক বিচারক রয়েছে যারা থার্ড ক্লাসধারী। শুনেছি আপিল বিভাগেও থার্ড ক্লাসধারী বিচারক রয়েছে। এমন যদি হয় তাহলে সুবিচার আসবে কি করে? বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, আদালতে ওই ব্যক্তির অবশ্যই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, মেধাসম্পন্ন, সৎ ও সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হতে হবে। কিন্তু সবসময়ই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে ক্ষমতাসীন সরকারের দলের আস্থাভাজন ও দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এ-ই যদি হয় বিচারক নিয়োগের অবস্থা, তাহলে সঠিক বিচার আসবে কি করে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, বিচারক নিয়োগের স্বচ্ছতায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিচারের রায় পক্ষে আসলে বিচার বিভাগ স্বাধীন, আর বিপক্ষে আসলেই পরাধীন- এটা সঠিক নয়। বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষায় সকলের সচেতনতা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধায়নে একটি স্বাধীন সেক্রেটারিয়েট থাকা খুবই জরুরি এবং আশা করা যাচ্ছে নিকট সময়ে তা বাস্তবে পাওয়া যাবে। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ এর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।
বিচার বিভাগ সেক্রেটারিয়েট গঠন করা প্রয়োজন
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাসন বিভাগে সম্পৃক্ত করা উচিত না। একটি বিচার বিভাগ সেক্রেটারিয়েট গঠন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সংবিধানে এক স্থানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দিবেন, আরেক স্থানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করবেন। আবার সংবিধানে বলা হয়েছে প্রধান বিচারপতি পরামর্শ দিবেন। তাই বিচারপতি নিয়োগে যদি প্রধান বিচারপতির মতামতই প্রাধান্য পায়, তাহলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব হয়। হয়তো বিচার বিভাগ হতে আমরা যতটা চাই ততটা পাইনি। কিন্তু স্বাধীনতার পর হতে বিচার বিভাগের অর্জন কম না।
হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের একযুগ পূর্তি ও মাসদার হোসেন মামলার ২০ বছর পূর্তিতে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন। এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখছি বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পুরোপুরি কার্যকরের স্বার্থে। উন্নয়নের জন্য বেশি নিবেদিত- এতটা প্রয়োজন আছে কি না তা প্রশ্নের দাবি রাখে। উন্নয়নের শরণার্থী যেন আমরা না হয়ে যাই সেদিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। আমরা হতাশ নই বরং আশাবাদী, সামনের সময়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনতার সুফল যেন সমাজের সকলে সমান ভাবে ভোগ করতে পারে। আমরা সে লক্ষ্যেই আমাদের কার্যক্রম নিয়ে জেগে আছি।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের এ আয়োজনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকে স্বাধীন করে তুলতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া।
মূল প্রবন্ধে মিজানুর রহমান খান বলেন, বিচারবিভাগ পৃথকীকরণে আমাদের পলায়নপরতার অবসান ঘটুক। মাসদার হোসেন মামলার অর্জনকে পাথেয় করেই অবশ্য আমাদের পথ চলতে হবে। কিন্তু অধস্তন আদালতের পুরো একটি চ্যাপ্টার সাংবিধানিকভাব কোমায় আছে কিনা, সেটা একটা বড় জিজ্ঞাসা। এমনও হতে পারে, হয়তো অলক্ষ্যে এভাবে পড়ে আছে। কিন্তু এভাবে থাকা তো সমিচীন নয়। তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে গঠনমূলক সম্পর্ক সংবিধান সুরক্ষা এবং আইনের শাসনের কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। ১৯৯৯ সালের মাসদার হোসেন মামলার রায়ের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ওই রায়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল ৮টি। পরে তা আপিল বিভাগে হয় ১২টি। উভয় রায়ের ক্ষেত্রে আদালতের সামনে যে বিষয়টি নেয়া হয়নি, এমনকি পরেও কোনো মামলায় নেয়া হয়নি, সেটি হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামো হিসেবে যাচাই করা। এছাড়া, ছয় দফার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই দফাটির অর্জন আছে, আবার নেই। একটি জুডিশিয়াল পে কমিশন করার কথা বলা ছিল। সেই কমিশনের শেষ চেয়ারম্যান ছিলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। কিন্তু তিনি অবসরে যাওয়ার পরে এটি আর কখনো গঠিত হয়েছে বলে জানা যায় না। সাত দফায় বলা হয়েছে, ১১৬ অনুচ্ছেদে অধীনে বিচারকদের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে মতের অমিল হলে সুপ্রিম কোর্টের মত প্রাইমেসি বা প্রাধান্য পাবে। কিন্তু এই দফা অর্জিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বিচারপতি মোস্তফা কামালের উদ্বৃতি দিয়ে তিনি বলেন, আমি একদিন তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, স্যার সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ মানতে সরকার বাধ্য? তিনি বলেছিলেন, না।
জাজমেন্টের সমালোচনা করলেই আদালত অবমাননা নয়
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, আমাদের দেশে জাজমেন্ট হয়। কিন্তু জাজমেন্টের পর কোনো সমালোচনা হয়না। জাজমেন্টের সমালোচনা করলেই কনটেমপট (আদালত অবমাননা) হবে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। একটি জাজমেন্টের চুলচেরা বিশ্লেষন ও গঠনমূলক সমালোচনা হতেই পারে। তিনি বলেন, বিচারপ্রার্থীদের সুবিচার দিতে হলে, কে খুশি হলো আর কে অখুশি হলো, কে বিরাগভাজন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি বলবেন, অমুকে কি বলবেন এসব ভাবলে সুবিচার আসবে না। যেটি সঠিক, যেটি সত্য এবং ন্যায় সঙ্গত রায়ে সেসব বিষয়ে স্বাধীনভাবে তুলে ধরতে হবে। এজন্য আমাদের চরিত্রে এবং অনুভূতিতে স্বাধীনতার বোধ থাকা প্রয়োজন, তাহলেই সত্যিকারের স্বাধীনতা আসবে।
বারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে সাবেক এই বিচারপতি বলেন, একটি শক্তিশালী বিচার ব্যাবস্থার জন্য বারকেও (আইনজীবী সমিতি) শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হয়। আইনজীবী সমিতি যদি আওয়ামী লীগ -বিএনপিতে বিভক্ত না হত এবং বার যদি ইউনাইটেড থাকতো তাহলে বিচার প্রার্থীদের সুবিচার পেতে আরো বেশি সহায়ক হতো। কেননা একটি ইউনাইটেড বার যদি না হয় তাহলে একটি শক্তিশালী বিচার ব্যবস্থা পাওয়া সম্ভব না। ন্যায় বিচার মানে মনিবের আনুগত্য নয় বরং আইনের আনুগত্য। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বার এবং বেঞ্চ-এর মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা করা প্রয়োজন।
বিচারবিভাগ আর্থিকভাবে স্বাধীন না হলে, পৃথকীকরই মূল্যহীন
সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন বলেন, নানামুখী প্রতিকূলতার মাঝে আমরা যে প্রত্যাশায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে স্বাক্ষর করেছিলাম তা হয়তো অনেকটাই কার্যকর হয়েছে। কিন্তু বিচারবিভাগ আর্থিকভাবে স্বাধীন না হলে এ পৃথকীকরণ অনেকটাই মূল্যহীন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি (বেলা) এর প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা একটা গ্লোবাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো কর্তৃত্বপরায়ন সরকারের উদ্দেশ্য থাকে তার বিরুদ্ধে যেন কোনো রায় না আসে, যদিও বিচারের ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সদাচার জনগণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ নির্বাহী বিভাগের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা রয়েছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, বর্তমানে বিচার বিভাগে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও আদালতের অত্যন্ত জটিল ব্যবস্থাপনা বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হওয়ার অন্তরায়। নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ একত্রিত হয়ে গেলে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই বিচার বিভাগের বাস্তবিক পৃথকীকরণের জন্য কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে নীতিমালা নেই
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবি সমিতির সাধারন সম্পাদক ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আমাদের বিচারবিভাগ বরাবরই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সবসময়ই সকল বিরোধী দল বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলে। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল থেকে বঞ্ছিত হওয়ার অনেক কারণই রয়েছে। এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের কোনো আইনও নেই, নীতিমালাও নেই। যদিও নিম্ন আদালতের বিচারক হতে পরীক্ষায় অংশ নিতেও যোগ্যতা লাগে। সেখানে থার্ড ক্লাসধারীরা আবেদন করতে পারে না। অথচ উচ্চ আদালত হাইকোর্টে অনেক বিচারক রয়েছে যারা থার্ড ক্লাসধারী। শুনেছি আপিল বিভাগেও থার্ড ক্লাসধারী বিচারক রয়েছে। এমন যদি হয় তাহলে সুবিচার আসবে কি করে? বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, আদালতে ওই ব্যক্তির অবশ্যই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, মেধাসম্পন্ন, সৎ ও সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হতে হবে। কিন্তু সবসময়ই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে ক্ষমতাসীন সরকারের দলের আস্থাভাজন ও দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এ-ই যদি হয় বিচারক নিয়োগের অবস্থা, তাহলে সঠিক বিচার আসবে কি করে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, বিচারক নিয়োগের স্বচ্ছতায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিচারের রায় পক্ষে আসলে বিচার বিভাগ স্বাধীন, আর বিপক্ষে আসলেই পরাধীন- এটা সঠিক নয়। বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষায় সকলের সচেতনতা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধায়নে একটি স্বাধীন সেক্রেটারিয়েট থাকা খুবই জরুরি এবং আশা করা যাচ্ছে নিকট সময়ে তা বাস্তবে পাওয়া যাবে। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ এর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।
বিচার বিভাগ সেক্রেটারিয়েট গঠন করা প্রয়োজন
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাসন বিভাগে সম্পৃক্ত করা উচিত না। একটি বিচার বিভাগ সেক্রেটারিয়েট গঠন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সংবিধানে এক স্থানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দিবেন, আরেক স্থানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করবেন। আবার সংবিধানে বলা হয়েছে প্রধান বিচারপতি পরামর্শ দিবেন। তাই বিচারপতি নিয়োগে যদি প্রধান বিচারপতির মতামতই প্রাধান্য পায়, তাহলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব হয়। হয়তো বিচার বিভাগ হতে আমরা যতটা চাই ততটা পাইনি। কিন্তু স্বাধীনতার পর হতে বিচার বিভাগের অর্জন কম না।
হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের একযুগ পূর্তি ও মাসদার হোসেন মামলার ২০ বছর পূর্তিতে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন। এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখছি বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের পুরোপুরি কার্যকরের স্বার্থে। উন্নয়নের জন্য বেশি নিবেদিত- এতটা প্রয়োজন আছে কি না তা প্রশ্নের দাবি রাখে। উন্নয়নের শরণার্থী যেন আমরা না হয়ে যাই সেদিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। আমরা হতাশ নই বরং আশাবাদী, সামনের সময়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনতার সুফল যেন সমাজের সকলে সমান ভাবে ভোগ করতে পারে। আমরা সে লক্ষ্যেই আমাদের কার্যক্রম নিয়ে জেগে আছি।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের এ আয়োজনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকে স্বাধীন করে তুলতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নে উদ্যোগী হওয়া।