শেষের পাতা

কেরানীগঞ্জে আগুন

সাখাওয়াতের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন কি পূরণ হবে?

স্টাফ রিপোর্টার

১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, রবিবার, ৯:০৭ পূর্বাহ্ন

ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে অঝোরে কাঁদছেন সাখাওয়াতের মা হাসিনা বেগম। ছেলেকে রেখে মায়ের গলা দিয়ে ভাত নামছে না। প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাখাওয়াত। কাছে যেতেই হাসিনা বেগম বলেন, আমার সাখাওয়াত নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। চার ভাই বোনের মধ্যে সে সবার বড়। বাবা নেই। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায়। সাখাওয়াতের উপার্জনেই চলে সংসার। তার বয়স মাত্র ২৭ বছর। হিসাবরক্ষক হিসেবে ১৩ হাজার টাকা বেতনে তিন বছর ধরে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে চাকরি করছিল সে। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছিল। এর আগে সাখাওয়াত প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত ও ভাইভাতে টিকলেও টাকার কারণে চাকরি হয়নি। এ বছরও প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় রিটেনে টিকে ভাইভা দিয়েছে। এখনো ফলাফল প্রকাশ হয় নি। তবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা সাখাওয়াতের বিশ্বাস ছিল এ বছর তার প্রাইমারি চাকরিটা হয়ে যাবে। সাখাওয়াতের দুই হাত-পা ও মুখমণ্ডলসহ শরীরের ৪৫ ভাগ পুড়ে গেছে। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে ভর্তি আছেন। মায়ের স্বপ্ন ছিল এ বছর স্কুলের চাকরিটা হলে ছেলেকে বিয়ে করাবেন। জিসানের বয়স ১৬ বছর। গ্রামের বাড়ি নড়াইল। সম্প্রতি সে জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। বাবা পেশায় কৃষক। তিন ভাই বোনের মধ্যে সে সবার বড়। জিসানের বাবা মো. আক্কাস মোল্লা বলেন, এক মাস আগে সে ঢাকায় এক বন্ধুর কাছে বেড়াতে আসে। এসময় বন্ধু তাকে প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। বন্ধুর কথায় রাজি হয়ে ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করে। আগুন লাগার পরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরো শরীরে আগুন লেগে যায়। এসময় তার মুখমণ্ডল, গলা, বুক, দুই হাত-পা পুড়ে গেছে। শরীরের ৩০ ভাগ পুড়ে গেছে বলে জানায় পরিবারের সদস্যরা।

মাথায় হাত দিয়ে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় বসে আছেন আজহার আলী। চোখে একরাশ হতাশা। কখনো ভাগিনার কাছে ছুটে যান কখনো ছেলের কাছে। ভাগিনা সোহান (১৮) শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি। ছেলে আসলাম (২০) ভর্তি ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে। তার শরীরের প্রায় ৭০ ভাগ পুড়ে গেছে। গ্রামের বাড়ি জামালপুর। আসলামের বাবা বলেন, গ্রামের কলেজ থেকে ছেলে স্নাতক পাশ করেছে। মাত্র ১০ দিন আগে সে ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করে। আগুন লাগার পর বেরুতে গিয়ে অগ্নিদগ্ধ হন। তিন ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। তার ফুপাতো ভাই সোহান একই ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো। সে বর্তমানে আইসিইউতে ভর্তি আছে। চিকিৎসকরা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন তার বাঁচার আশা ক্ষীণ।

দগ্ধ লাল মিয়ার (৪৫) ভাই বাদল বলেন, অগ্নিকাণ্ডের একদিন পর আমরা খবর পাই। ঘটনার দিন সে আসর নামাজ শেষে ফ্যাক্টরির ভেতরে প্রবেশ করেণ। এর কয়েক মিনিট পরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। হঠাৎ করে জ্বলন্ত দুটি প্লাস্টিকের টুকরো এসে তার হাটুতে লাগে। এসময় তার প্যান্টে আগুন লেগে যায়। মাথা নিচু করে প্যান্ট ছিড়ে ফেলার সময় তার মুখ ও বুক পুড়ে যায়। এরপর সে শরীরের জামা ছিড়ে ফেলে। তার শরীরের প্রায় ৩৫ ভাগ পুড়ে গেছে। লাল মিয়ার গ্রামের বাড়ি নরসিংদির শিবগঞ্জে। তার তিন ছেলে মেয়ে রয়েছে।

জাকির হোসেনের (২৪) ২৯ ভাগ পুড়ে গেছে। ঢামেকের এইচডিইউতে ভর্তি । তার বাবা মো. আবুল হোসেন বলেন, গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুর। ৪ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট সে। গত চার বছর ধরে ফ্যাক্টরিতে প্রিন্টিং সেকশনে চাকরি করছে। বাবা অন্যের খেত খামারে কাজ করলেও জাকিরের টাকায় চলে সংসার। বসৎভিটা ছাড়া তাদের অবসিষ্ট কিছু নেই। ঘটনার দিন সে প্রিন্টিং এ কাজ করছিলেন। হঠাৎ করে আগুন লেগে যায়। এসময় সে আগুন নিভে যাবে সেই অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকে। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যেই পুরো ফ্যাক্টরিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এসময় তার সমস্ত শরীরে আগুন ধরে যায়। শরীরের আগুন নিয়ে সে ফ্যাক্টরি থেকে বেড়িয়ে এলোমেলোভাবে দৌড়াতে থাকে। এসময় রাস্তার লোকজন তার শরীরের আগুন নিভায়। পরবর্তীতে নিজেই সিএনজি নিয়ে হাসপাতালে চলে আসে।

এদিকে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় আগুনে দগ্ধ আরেকজন মারা গেছে। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকাল পৌনে আটটার দিকে আসাদ (১৬) নামের দগ্ধ কিশোরের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে কারখানায় আগুন লাগার ঘটনায় মোট ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল সাংবাদিকদের বলেন, আগুন লাগার ঘটনায় আসাদসহ ১০ জন আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। একজন মারা যাওয়ার পর এখন আরও ৯ জন লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ৮ জন ভর্তি রয়েছেন। তারা কেউ শঙ্কামুক্ত নন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status