শেষের পাতা

আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার- পররাষ্ট্র সচিব

কূটনৈতিক রিপোর্টার

১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৯:০২ পূর্বাহ্ন

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কারণে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপে পড়েছে মিয়ানমার। এমনটাই মনে করছেন পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক। সচিবের ভাষ্য হচ্ছে- নিজেদের অপরাধ ঢাকতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ চাইলেই ইস্যুটি আমলে নিতে পারে। কারণ মামলা করার সুযোগ এখনও রয়েছে। যুক্তি পাল্টা যুক্তি আর খন্ডনের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার শেষ হয় আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দায়ের করা গাম্বিয়ার মামলার অন্তবর্তী আদেশের শুনানি। যেখানে মিয়ানমার দাবি করে, ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মামলা করতে পারে, গাম্বিয়া নয়। তবে গাম্বিয়া তার যুক্তি প্রমাণ দিয়ে আদালতকে এটা বুঝিয়েছে যে মানবাধিকার সংবেদনশীল রাষ্ট্র হিসাবে এবং গণহত্যা সনদে সই করা হিসাবে গাম্বিয়া ওই মামলা করতে পারে। বিবাদি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি আদালতে এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, রাখাইনে যুদ্ধাপরাধ হয়ে থাকতে পারে।

তিনি গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এ সংক্রান্ত কোন অন্তবর্তী আদেশ না দিতে আদালতের প্রতি আর্জি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের শরণার্থী ও অভিবাসন বিশ্লেষক আসিফ মুনির মনে করেন, বাংলাদেশ চাইলে এখনও ওই আদালতে বাংলাদেশ মামলা করতে পারে। তবে যেহেতু রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে চেষ্টা করছে সেহেতু সরাসরি মামলায় চলে গেলে প্রত্যাবাসনে সময়নষ্ট করার আরেকটা ইস্যু তৈরি করতে পারে মিয়ানমার। গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলাকেও প্রত্যাবাসন দেরি করার ক্ষেত্রে ইস্যু করতে পারে মিয়ানমার এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং আন্তর্জাতিক চাপ ধরে রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে যে শুনানি হয়েছে এবং সেখানে যেভাবে রাখাইনের গণহত্যার বিষয়টি গাম্বিয়ার আইনজীবীরা যুক্তিপ্রমাণ দিয়ে আদালতের বিবেচনায় উপস্থাপন করেছেন তাতে বাংলাদেশ সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক বিবৃতিতে এ নিয়ে সন্তোষ ব্যক্ত করা হয়েছে। ওই শুনানি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের ১১ সদস্যের সরকারী প্রতিনিধি দল নিয়ে আদালতে উপস্থিত ছিলেন, পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) এম শহিদুল হক। মানবজমিনকে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে বিশেষ করে গণহত্যা, জাতিগত নিধনের যুক্তিগুলো খন্ডাতে পারেনি মিয়ানমার। আদালতের কাঠগড়ায় মিয়ানমার যে চাপের মুখে পড়েছে তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গাম্বিয়ার করা মামলায় আট থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে অন্তবর্তী একটি আদেশ দিতে পারেন আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ভাষ্য: সু চি অতীত বিসর্জন দিয়েছেন ভবিষ্যতের লক্ষ্যে: এদিকে, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বলছে, নির্বিকার মুখে আদালতে বসে তার দেশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ শুনছিলেন মিয়ানমারের ডি ফ্যাকটো নেতা অং সান সু চি। একসময় ‘নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর’ উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। সেই সু চি নৃশংস অভিযোগের জবাবগুলোকে ‘সব মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রমের প্রতীক হয়ে ওঠা সুচির নিপীড়কের পক্ষ এবং শাসক জান্তার অস্ত্রের ঝনঝনানিতেই আস্থা রাখায় হতাশ গোটা দুনিয়া। এ নিয়ে ইকোনমিস্ট, গার্ডিয়ান, বিবিসি, সিএনএন, ফরেন পলিসি, ডিপ্লোম্যাটসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় বইছে। দুনিয়া বলছে, সামরিক জান্তার বিশ্বাসভাজন হতে এবং ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সুবিধা পেতে সুচি নিজের অতীতের সুনাম বিসর্জন দিয়েছেন। অবশ্য এ জন্য তিনি তার দেশের কট্টর জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন পেয়েছেন। রেঙ্গুনে তার সমর্থনে মিছিল হয়েছে। বহুত্ববাদী ধারণার গলা টিপে কট্টর জাতীয়তাবাদী রূপে দেখা দিয়েছেন সুচি। অন্তত আদালতে তার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। অভিযোগের শুনানিতে গাম্বিয়া রোহিঙ্গা গণহত্যার অকাট্য প্রমাণগুলো উপস্থাপন করছিলো, প্রামাণ্যচিত্র ও নথিপত্র দাখিল করছিলো, তখন অনেকটা আচমকা মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি বললেন, সেনাসদস্যরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকতে পারে, এটি তারা মিয়ানমারের দেশীয় তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করবেন। এটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের কোন সুযোগ নেই।

তিনি এ-ও বললেন, ১৯৪৮-এর গণহত্যা সনদ এখানে প্রযোজ্য নয়। বৃটেনের দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যে সু চি ১৫ বছর অন্তরীণ ছিলেন, তিনিই এখন জেনারেলদের পক্ষে ওকালতি করলেন। তার এই রূপান্তরকে ‘বিস্ময়কর’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে গণমাধ্যমটি বলছে, হেগে নিজের যাওয়ার বিষয়টি সু চি খুব ভেবে চিন্তে ফলাও করে প্রচার করেছেন স্থানীয় রাজনীতিতে ফায়দা লোটার স্বার্থ। আর তাতেই অন্ধ হয়ে নিজের এত দিনের সম্মান-ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক লেপনেও কাঁপেননি তিনি। বিবিসির মতে, ২০১৫-এর নির্বাচনে সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় এলেও তাতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমেনি। বরং এখনো মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে। এতে কার্যকর নেতা সু চি হলেও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নে তার ক্ষমতা অকার্যকর। গার্ডিয়ান তার সম্পাদকীয়তে বলেছে, গণহত্যা সংঘটনের অসংখ্য প্রামাণিক তথ্য উপস্থাপিত হওয়ার পরও সব এক বাক্যে ‘নাকচ’ করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন সু চি। তিনি একবারও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি।

এটা স্পষ্ট যে পুতুল সরকারের নেতা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন এটা মনে করার কোন কারণ নেই। বরং এখানে তারা রাজনৈতিক স্বার্থও আছে। তাই মিয়ানমারের ভোটারদের কাছে ভালো সাজতে সুচি তার বিবেকক জলাঞ্জলি দিতেও কুন্ঠাবোধ করেননি। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ওপর বর্মী সেনাদের নিপীড়নের অভিযোগগুলো মিয়ানমারের স্থানীয় আদালত, বিশেষ করে সামরিক আদালতে বিচার হবে জানিয়ে সুচি গাম্বিয়ার বিভিন্ন তথ্যকে বিভ্রান্তিকর বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে সংঘাতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রাখাইনের ঘটনাগুলো অস্বীকার না করলেও এটাকে গণহত্যার সমতুল্য বলে মানেননি তিনি। সেনাবাহিনীর বলপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার পক্ষেও সুচি সাফাই গেয়েছেন। ডিপ্লোম্যাট পত্রিকার প্রতিবেদন বলছে, নির্যাতনের সব অভিযোগকে ‘অবহেলা’ ও ‘উপেক্ষা’ করেছেন সুচি। যদিও জাতিসংঘের সাবেক মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রা’দ আল হুসেইন সিএনএনকে বলেছেন, সু চি নিজেদের পক্ষে যে সাফাই গেয়েছেন, তা দুনিয়ার বিচারে ‘হাস্যকর’।

বাংলাদেশি বিশ্লেষকদের মতে গাম্বিয়ার মামলায় শুনানি মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াবে: গাম্বিয়ার বক্তব্যে হত্যা, শিশু হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং গণউচ্ছেদের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর নীতিতেই গণহত্যার উদ্দেশ্য নিহিত ছিল বলে আদালতকে অবহিত করা হয়। এ ছাড়া গণহত্যা এখনো চলমান, বিধায় তা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। জবাবে বিবাদি মিয়ানমারের এজেন্ট অং সান সু চি গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। সন্ত্রাসবিরোধী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’-এ সেনাসদস্যদের ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ স্বীকার করেন দেশীয় আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ চেয়ে আদালতে আর্জি জানিয়েছেন। এ জন্য অন্তবর্তী কোন আদেশ না দিতে আদালতকে অনুরোধ করেছেন। এই প্রেক্ষাপটে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, তিনটি প্রশ্ন অনেকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এক. গাম্বিয়া কেন? দুই. বাংলাদেশ কেন নয়? তিন. মামলার রায়ে যদি মিয়ানমারকে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে কি রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে? বিশ্লেষণে তিনি বলেছেন, প্রথম প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক এ জন্য যে, এ রকম মামলা সাধারণত পার্শ্ববর্তী দেশ, যাদের স্বার্থ রয়েছে তারাই করে থাকে। গাম্বিয়া তো দূরবর্তী এক রাষ্ট্র, যার কোনো সরাসরি স্বার্থ নেই এ বিষয়ে। জবাব হচ্ছে- গাম্বিয়া মামলাটি করেছে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষ থেকে। ওআইসির পক্ষ থেকে গাম্বিয়াকে নির্বাচনের কারণ, আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তাম্বাদু এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। রুয়ান্ডা গণহত্যার মামলা তিনি পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও এ বিষয়ে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন চায়। যদি মামলায় বাংলাদেশ পক্ষ হতো, তাহলে মিয়ানমার একটি অজুহাত পেয়ে যেত দ্বিপক্ষীয় প্রয়াস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আর এ প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবাসনের ঝুলে যেতো। তৃতীয়ত: মামলার রায় যদি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাহলে তাদের পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই আসবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status