বাংলারজমিন

‘হানাদাররা টিকতে না পেরে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়’

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৮:০৪ পূর্বাহ্ন

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফণী ভূষণ চক্রবর্তী। ৬৫ বছর বয়সী চিরকুমার এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৩ নং শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের সবুজবাগ এলকায় বসবাস করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন সাব সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাসহর সাব-সেক্টরে লেফটেন্যান্ট ওয়াকিউজ্জামানের অধীনে ভগবানপুর ট্রানজিট ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ইস্টার্ন কমান্ড ফোর-এর অধীনে ভারতের নাসিমপুর ও লোহারবন্দে ট্রেনিং নেন। তখন তিনি ছিলেন শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মেট্রিক (এসএসসি) পরীক্ষার্থী।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতর্পণ করতে গিয়ে ফণী ভূষণ চক্রবর্তী বলেন, ‘১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়। ১ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সাফল্যের সঙ্গে জকিগঞ্জ দখল করে। জকিগঞ্জ দখলের পর সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কানাইঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান। কানাইঘাটে ছিল পাক হানাদার বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি। ওখানে ছিল পাকিস্তানের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা বাহিনী। তাদের সহযোগিতায় ছিল শতাধিক মিলিশিয়া এবং বেশকিছু রাজাকার।
কানাইঘাট-দরবস্তের সঙ্গে সংযোগ সড়কটি ছিল কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হতে হলে এই ঘাঁটিটি দখলে নেয়া ছিল আমাদের জন্য খুবই জরুরি। পরিকল্পনা অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট গিয়াসের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে কানাইঘাট-দরবস্ত সড়কে এবং লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে কানাইঘাট-চরখাই সড়কে মোতায়েন করা হয়। বাকি দুটো কোম্পানি মেজর আব্দুর রবের নেতৃত্বে সুরমা নদী পেরিয়ে কানাইঘাট আক্রমণ করবে। আমি ছিলাম মেজর রবের নেতৃত্বে ডিফেন্স কোম্পানিতে। অগ্রবর্তী দলকে ডিফেন্স দেয়া ছিল এই কোম্পানির কাজ। সবদিক গুছিয়ে আনার একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী নভেম্বরের শেষদিকে (২৫ বা ২৬ তারিখ হবে) অতর্কিতে আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা তখন কানাইঘাট থেকে দুই মাইল দূরে গৌরীপুরে। পাকিস্তানি বাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার ও শেলিংয়ের মাধ্যমে প্রচণ্ড আক্রমণে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছিল। আমাদের দলের কমান্ডার বজলুল গণি ওয়্যারলেসের মাধ্যমে অবস্থা বর্ণনা করে বিভিন্ন সাব-স্টেশনে সাহায্যের বার্তা পাঠান। কিন্তু উপর থেকে নির্দেশ আসে যেকোনো অবস্থায় আমাদের অবস্থান ধরে রাখতে হবে। অসীম মনোবল আর দেশকে শত্রুমুক্ত করার তাড়নায় আমরা আমাদের অবস্থান ধরে রাখি। প্রায় আধঘণ্টা অবস্থান ধরে রাখার পর আমাদের ডান পাশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো একটি দল মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে মেশিনগান আর এলএমজি ফায়ার করে এগিয়ে যায়। আমরাও আমাদের অবস্থান থেকে ফায়ার করতে থাকি। পরে জানতে পারি মেজর ওয়াকার হাসান বীর প্রতীকের নেতৃত্বে ৩০ জনের একটি দল সেদিন আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধ। উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল গোলাগুলি। মেজর ওয়াকার তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে ক্রল করে পৌঁছে যান পাকিস্তানি বাহিনীর একেবারে কাছাকাছি। পেছন থেকে আমরাও অগ্রবর্তী দলকে সাপোর্ট দিয়ে যাই। অবস্থা বেগতিক দেখে হানাদাররা পিছু হটতে থাকে। এই যুদ্ধের স্মৃতি মনে হলে এখনো শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে।’
কানাইঘাটের যুদ্ধে সফলতার পর ফণী ভূষণ চক্রবর্তীসহ ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ভারতের উত্তর ত্রিপুরার রানীবাড়ি ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, ‘সেখানে আসাম রেজিমেন্টের মিলিটারি সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের অধীনে পাঁচদিনের ট্রেনিং শেষে আমিসহ পাঁচজনকে শমসেরনগরে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য পাঠানো হয়। ১লা ডিসেম্বর রাতে টিলাবাজার ক্যাম্প হয়ে আমরা নমৌজার উত্তরে মূর্তিছড়া চা বাগান দিয়ে রবিরবাজার পর্যন্ত এগিয়ে যাই। ওই রাতেই রবিরবাজারের কাছাকাছি পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। আমাদের দলের দুজনের কাছে ছিল তখন রাশিয়ান এসএলআর, একটি এসএমজি এবং তিনটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল। পঁচিশ মিনিট ধরে তাদের সঙ্গে আমাদের গুলি বিনিময় হয়। তবে এখানে কোনোপক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পাকিস্তানিরা গুলি ছুড়ে পিছু হটে। তারা সংখ্যায় ছিল ২৫-৩০ জন। আর আমরা মাত্র পাঁচজন। এই বিবেচনায় পাকিস্তানিদের ধাওয়া না করে আমরা সূর্য ওঠার আগেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে টিলাবাজার ক্যাম্পে ফিরে যাই।’
এরপর ফণী ভূষণ চক্রবর্তীসহ ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে ক্যাপ্টেন সুখলালের নেতৃত্বে পাঠানো হয় রানীবাড়ি ক্যাম্পে। ওই ক্যাম্পে জুড়ি ও কুলাউড়া শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। ফণী ভূষণ বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩রা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমরা ক্যাপ্টেন সুখলালের নেতৃত্বে জুড়ির দিকে অগ্রসর হই। বিনা বাধায় আমরা সাগরনাল দখলে নেই। রত্না চা বাগানে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করে বিফল হয়। হানাদাররা টিকতে না পেরে কাপনা পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়। ৪ঠা ডিসেম্বর সকাল থেকে জুড়ির পথে পথে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা এগিয়ে যাই। উভয় পক্ষে প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওয়্যারলেস বার্তায় আমাদের অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশ দেয়া হয় যেকোনো মূল্যে কুলাউড়া শত্রুমুক্ত করার। মৃত্যুর পরোয়া না করে আমরা এগুচ্ছি। আমাদের তখন কাহিল অবস্থা। দিনের আলোয় সবকিছু দেখা যাচ্ছে। বোমারু বিমান আকাশে উড়ছে। আমরা তখন ফায়ার বন্ধ করে ক্রলিং অবস্থায় মাটিতে শুয়ে আছি। মিত্র বাহিনীর বোমারু বিমানগুলো কুলাউড়া ও জুড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে শেলিং করছে। আমাদের মনোবল আরো বেড়ে যায়। আমরা নতুন অনুপ্রেরণায় সামনের দিকে এগিয়ে যাই। কয়েক দফা বিমান হামলার পর পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ দুর্গ ভেঙে যায়। তারা পালিয়ে যায়। শত্রুমুক্ত হয় জুড়ি ও কুলাউড়া।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status