প্রথম পাতা
পোশাক রপ্তানি
বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ভিয়েতনাম
এম এম মাসুদ
১০ ডিসেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:৩৩ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। কিন্তু ইতিমধ্যে বছরের প্রথম ৯ মাসে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে ভিয়েতনাম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ৬১০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে, একই সময়ে ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের পোশাক। অর্থাৎ ৯ মাসে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম ৩২০ কোটি ডলারের পোশাক বেশি রপ্তানি করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ওদিকে, অব্যাহতভাবে কমছে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট আকারের কারখানা । কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, চাহিদা কমা এবং পোশাকের দাম না বাড়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিজিএমইএ মনে করে, পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম আমাদের ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। বছর শেষে সেটি অব্যাহত থাকতে পারে। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রয়াদেশ চীন থেকে ভিয়েতনামে স্থানান্তরিত হয়েছে। ভিয়েতনামের পোশাক খাতে চীনাদের বিনিয়োগই বেশি। বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর পর তারাই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ভিয়েতনামে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে, নানা কারণে আমাদের কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে গেছে। সে জন্য বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল কাঙিক্ষত মাত্রায় নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানি আয় কমছে মূলত তৈরি পোশাকের ক্রয় আদেশ (অর্ডার) কমে যাওয়ার কারণে। এছাড়া, কিছু নতুন প্রতিযোগী দেশও তৈরি হয়েছে। মিয়ানমার, ভারত, পাকিন্তান ও ভিয়েতনামে পোশাকের অর্ডার বাড়ছে।
বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বলেন, আমদের এতগুলো ফ্যাক্টরি থাকা স্বত্ত্বেও ঠিকমতো মূল্য পাই না। এভাবে চলতে থাকলে দশ বছর পর শিল্প থাকবে কিনা বলা মুশকিল। এছাড়া সংকট যেভাবে বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী দিনে তৈরি পোশাক খাত তথা রপ্তানি খাত আরো খারাপ অবস্থার দিকেই যাবে।
এদিকে, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে ভিয়েতনাম অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ভিয়েতনাম চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৩৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২.৭০ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৪৫৬ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯.৯৬ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে, বাজারটিতে শীর্ষ রপ্তানিকারক চীনের রপ্তানি কমেছে ১.১০ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে চীন রপ্তানি করেছে ২ হাজার ১০ কোটি ডলারের পোশাক।
ভিয়েতনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর কয়েকটি বাজারে জটিলতা থাকার পরও দেশটির পোশাক রপ্তানি ৪ হাজার কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাবে। ইতিমধ্যে ৯ মাসে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানির পাশাপাশি ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজারও ৯০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০১৯ অনুযায়ী, গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত, তুরস্ক, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র, এই শীর্ষ ১০টি দেশ ৪২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা মোট রপ্তানির ৮৩.৩ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে চীন।
চীনের পরই একক দেশ হিসেবে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ স্থানে আছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ ৩ হাজার ২৯২ কোটি এবং ভিয়েতনাম ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। উভয় দেশের পরিমাণ প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। গত বছর ১০ শীর্ষ রপ্তানিকারকের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৬.৪ শতাংশ। অন্যদিকে ভিয়েতনামের রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ৬.২ শতাংশ।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ায় আগামীতে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ইপিবি হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তৈরি পোশাক খাতে ১ হাজার ৩০৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আয় হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ৭.৭৪ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩.৬৩ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে এই খাতে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৪১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আলোচিত সময়ে ওভেন পোশাকে রপ্তানি আয় কমেছে ৮.৭৪ শতাংশ, আর নিট পোশাকে ৬.৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই দুই খাতে আয় কমেছে যথাক্রমে ১৮.২০ ও ৮.৯৪ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধরন বদলাচ্ছে তৈরি পোশাকের ব্যবসায়। যার সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য না থাকাই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন পোশাক রপ্তানিকারকরা। একই কারণে বাংলাদেশ, চীনের হারানো বাজারও ধরতে পারছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
পোশাক উদ্যোক্তারা জানান, দেশের তৈরি পোশাক শিল্পখাত এখন চরম দুঃসময় কাটাচ্ছে। অসম ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় রপ্তানিমূল্যও প্রতিনিয়ত কমছে। একারণে রপ্তানিবাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী সম্ভাবনাময় তৈরি পোশাক শিল্প খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। কিন্তু পণ্যের দাম সে তুলনায় বাড়েনি, উল্টো কমেছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা। গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৩০০ কারখানা। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন লাখ লাখ শ্রমিক। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রপ্তানি আয়ে।
বিকেএমইএ ১ম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমদের উপরে অনেক চাপ থাকে। নানান বাধা থাকে। আবার প্রথম সাত কর্ম দিবসের মধ্যে শ্রমিকের বেতন দিলাম কি দিলাম না সেটাও তারা মনিটরিং করে।
এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইউরোপ অঞ্চলের দেশগুলোতে এখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার তুলনামূলক ভালো হলেও আমরা সেভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। এ কারণে আমাদের দেশে রপ্তানিতে বিপর্যয় নেমেছে। ভারত, পাকিস্তানসহ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের নিজস্ব মুদ্রার সঙ্গে ডলারের ডিভ্যালুয়েশন করেছে। কিন্তু আমাদের মুদ্রা তথা টাকার সঙ্গে ডলারের ডিভ্যালুয়েশন হচ্ছে না। ফলে আমরা প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছি। আমাদের অর্ডার কমে যাচ্ছে।
সমপ্রতি বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যাবার অন্যতম কারণ হচ্ছে লিড টাইম (পণ্য সরবরাহের সময়সূচি) বেশি হওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার উচ্চমান এবং বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি মোকাবিলায় চীনা উদ্যোক্তাদের কারখানা ভিয়েতনামে স্থানান্তর। অপরদিকে, পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের লিড টাইম কম হওয়া, উন্নত অবকাঠামো, ভালো বন্দর সুবিধা, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সক্ষমতার কারণেও উদ্যোক্তাদের আগ্রহ ভিয়েতনামের প্রতি বেড়েছে।
এদিকে, টানা ৫ মাস ধরে কমছে রপ্তানি আয়। আর এতে আতংকিত হয়ে পড়েছেন রপ্তানিকারকরা। পোশাক শিল্প মালিকরা জরুরিভিত্তিতে সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চেয়েছেন। তানাহলে আগামী দিনগুলোতেও ‘এই নেতিবাচক’ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশংকা করছেন তারা।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, খুবই খারাপ অবস্থা। আমাদের সব অর্ডার ভিয়েতনাম-ভারতে চলে যাচ্ছে। সরকারের পলিসি সাপোর্ট ছাড়া এই খারাপ অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারবো না। ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ৬০টি কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের পলিসি সাপোর্ট দরকার।
বিজিএমইএ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাকের উৎপাদন খরচ প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত ৫ বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিপরীতে উৎপাদিত পণ্যের দাম না বেড়ে প্রতিনিয়ত কমছে। এ সময়ে প্রধান রপ্তানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পোশাকের দরপতন হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। ইউরোপে দরপতন হয়েছে ৩.৬৪ শতাংশ।
বিজিএমইএ একজন পরিচালক বলেন, আমরা যে অর্ডার হারাচ্ছি তা সত্য। মিয়ানমার গত বছর ১০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানি করেছে। তার আগের বছর রপ্তানি করেছে ৪ বিলিয়ন ডলারের। এই ব্যবসা বাংলাদেশ থেকেই গেছে।
বিজিএমইএ মনে করে, পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম আমাদের ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। বছর শেষে সেটি অব্যাহত থাকতে পারে। বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রয়াদেশ চীন থেকে ভিয়েতনামে স্থানান্তরিত হয়েছে। ভিয়েতনামের পোশাক খাতে চীনাদের বিনিয়োগই বেশি। বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর পর তারাই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের ভিয়েতনামে নিয়ে গেছে। অন্যদিকে, নানা কারণে আমাদের কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে গেছে। সে জন্য বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল কাঙিক্ষত মাত্রায় নিতে পারেনি বাংলাদেশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানি আয় কমছে মূলত তৈরি পোশাকের ক্রয় আদেশ (অর্ডার) কমে যাওয়ার কারণে। এছাড়া, কিছু নতুন প্রতিযোগী দেশও তৈরি হয়েছে। মিয়ানমার, ভারত, পাকিন্তান ও ভিয়েতনামে পোশাকের অর্ডার বাড়ছে।
বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বলেন, আমদের এতগুলো ফ্যাক্টরি থাকা স্বত্ত্বেও ঠিকমতো মূল্য পাই না। এভাবে চলতে থাকলে দশ বছর পর শিল্প থাকবে কিনা বলা মুশকিল। এছাড়া সংকট যেভাবে বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী দিনে তৈরি পোশাক খাত তথা রপ্তানি খাত আরো খারাপ অবস্থার দিকেই যাবে।
এদিকে, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধিতে ভিয়েতনাম অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ভিয়েতনাম চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৩৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২.৭০ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৪৫৬ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯.৯৬ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে, বাজারটিতে শীর্ষ রপ্তানিকারক চীনের রপ্তানি কমেছে ১.১০ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে চীন রপ্তানি করেছে ২ হাজার ১০ কোটি ডলারের পোশাক।
ভিয়েতনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর কয়েকটি বাজারে জটিলতা থাকার পরও দেশটির পোশাক রপ্তানি ৪ হাজার কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাবে। ইতিমধ্যে ৯ মাসে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানির পাশাপাশি ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজারও ৯০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিসটিকস রিভিউ ২০১৯ অনুযায়ী, গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত, তুরস্ক, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র, এই শীর্ষ ১০টি দেশ ৪২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা মোট রপ্তানির ৮৩.৩ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে চীন।
চীনের পরই একক দেশ হিসেবে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ স্থানে আছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশ ৩ হাজার ২৯২ কোটি এবং ভিয়েতনাম ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। উভয় দেশের পরিমাণ প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। গত বছর ১০ শীর্ষ রপ্তানিকারকের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৬.৪ শতাংশ। অন্যদিকে ভিয়েতনামের রপ্তানি বেড়ে হয়েছে ৬.২ শতাংশ।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ায় আগামীতে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ইপিবি হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তৈরি পোশাক খাতে ১ হাজার ৩০৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা আয় হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ৭.৭৪ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩.৬৩ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে এই খাতে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৪১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আলোচিত সময়ে ওভেন পোশাকে রপ্তানি আয় কমেছে ৮.৭৪ শতাংশ, আর নিট পোশাকে ৬.৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই দুই খাতে আয় কমেছে যথাক্রমে ১৮.২০ ও ৮.৯৪ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধরন বদলাচ্ছে তৈরি পোশাকের ব্যবসায়। যার সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। পণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য না থাকাই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন পোশাক রপ্তানিকারকরা। একই কারণে বাংলাদেশ, চীনের হারানো বাজারও ধরতে পারছে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
পোশাক উদ্যোক্তারা জানান, দেশের তৈরি পোশাক শিল্পখাত এখন চরম দুঃসময় কাটাচ্ছে। অসম ও অসুস্থ প্রতিযোগিতায় রপ্তানিমূল্যও প্রতিনিয়ত কমছে। একারণে রপ্তানিবাণিজ্যে ৮৪ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী সম্ভাবনাময় তৈরি পোশাক শিল্প খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। কিন্তু পণ্যের দাম সে তুলনায় বাড়েনি, উল্টো কমেছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা। গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে অন্তত ১ হাজার ৩০০ কারখানা। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন লাখ লাখ শ্রমিক। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রপ্তানি আয়ে।
বিকেএমইএ ১ম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমদের উপরে অনেক চাপ থাকে। নানান বাধা থাকে। আবার প্রথম সাত কর্ম দিবসের মধ্যে শ্রমিকের বেতন দিলাম কি দিলাম না সেটাও তারা মনিটরিং করে।
এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইউরোপ অঞ্চলের দেশগুলোতে এখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার তুলনামূলক ভালো হলেও আমরা সেভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। এ কারণে আমাদের দেশে রপ্তানিতে বিপর্যয় নেমেছে। ভারত, পাকিস্তানসহ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের নিজস্ব মুদ্রার সঙ্গে ডলারের ডিভ্যালুয়েশন করেছে। কিন্তু আমাদের মুদ্রা তথা টাকার সঙ্গে ডলারের ডিভ্যালুয়েশন হচ্ছে না। ফলে আমরা প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছি। আমাদের অর্ডার কমে যাচ্ছে।
সমপ্রতি বিশ্ব ব্যাংক প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যাবার অন্যতম কারণ হচ্ছে লিড টাইম (পণ্য সরবরাহের সময়সূচি) বেশি হওয়া, ডলারের বিপরীতে টাকার উচ্চমান এবং বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি মোকাবিলায় চীনা উদ্যোক্তাদের কারখানা ভিয়েতনামে স্থানান্তর। অপরদিকে, পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের লিড টাইম কম হওয়া, উন্নত অবকাঠামো, ভালো বন্দর সুবিধা, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সক্ষমতার কারণেও উদ্যোক্তাদের আগ্রহ ভিয়েতনামের প্রতি বেড়েছে।
এদিকে, টানা ৫ মাস ধরে কমছে রপ্তানি আয়। আর এতে আতংকিত হয়ে পড়েছেন রপ্তানিকারকরা। পোশাক শিল্প মালিকরা জরুরিভিত্তিতে সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চেয়েছেন। তানাহলে আগামী দিনগুলোতেও ‘এই নেতিবাচক’ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশংকা করছেন তারা।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, খুবই খারাপ অবস্থা। আমাদের সব অর্ডার ভিয়েতনাম-ভারতে চলে যাচ্ছে। সরকারের পলিসি সাপোর্ট ছাড়া এই খারাপ অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পারবো না। ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ৬০টি কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের পলিসি সাপোর্ট দরকার।
বিজিএমইএ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাকের উৎপাদন খরচ প্রতি বছর গড়ে ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত ৫ বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বিপরীতে উৎপাদিত পণ্যের দাম না বেড়ে প্রতিনিয়ত কমছে। এ সময়ে প্রধান রপ্তানি বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী পোশাকের দরপতন হয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। ইউরোপে দরপতন হয়েছে ৩.৬৪ শতাংশ।
বিজিএমইএ একজন পরিচালক বলেন, আমরা যে অর্ডার হারাচ্ছি তা সত্য। মিয়ানমার গত বছর ১০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানি করেছে। তার আগের বছর রপ্তানি করেছে ৪ বিলিয়ন ডলারের। এই ব্যবসা বাংলাদেশ থেকেই গেছে।