এক্সক্লুসিভ

কেমন আছে রাজীব-দিয়ার পরিবার

মরিয়ম চম্পা

৪ ডিসেম্বর ২০১৯, বুধবার, ৭:২৯ পূর্বাহ্ন

বেলা সাড়ে ১১টা। মহাখালীর দক্ষিণপাড়া গলির বড় মসজিদের পাশেই আলী ভিলা। তৃতীয় তলায় থাকেন দিয়া খানম মীমের পরিবার। বাসায় প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ছোট্ট একটি দোলনা। আর দোলনার পাশেই শুয়ে আছে ছোট্ট দিয়া। তার বাবা বললেন, এই আমাদের দিয়া। ৪ মাস আগে মায়ের কোল জুড়ে এসেছে আমার দিয়া মা। ওকে আমরা মীম নামে ডাকি। পাশেই শূন্য রুমটি সাজানো দিয়ার ছবি দিয়ে। মেয়ের কথা জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন দিয়ার মা রোকসানা বেগম। বলেন, আমি এক মুহূর্তের জন্যও দিয়াকে ভুলতে পারি না। ও আছে আমার হৃদয়ে। ছোট্ট মেয়ের হাসি, চেহারা সব কিছুই দিয়ার মত দেখতে। তাই ওকে আমরা দিয়া ও মীম বলেই ডাকি। প্রথম দিকে ওকে আমি কোলে নিতাম না। মনে হত এই বুঝি আমার দিয়ার স্থান সে দখল করবে। আমি হয়তো দিয়াকে ভুলে যাবো।

আমার ডান হাতটি এখন আর কাউকে ধরতে দেই না। দিয়া বেঁচে থাকতে আমরা রাস্তায় হাটতে গেলে ওরা দু’বোন আমার দুই হাত ধরে হাটতো। কিন্তু আমার শূন্য হাতটি তো আর দিয়া ধরছে না। এখন আমি বড় মেয়ে রিয়াকে আমার হাত ধরতে দেই না। দিয়া চলে যাওয়ার ১৬ মাস চলছে। কিন্তু আমার হৃদয়ের ক্ষত’তো আজও শুকোয় নি। আমাদের বিবাহ বার্ষিকী ও মা দিবসে  দিয়া আমাকে কিছু না কিছু উপহার দিতো। টাকা না থাকলে তখন কাগজ দিয়ে কিছু একটা বানিয়ে উইস করতো। শেষবার ও আমাকে কাগজ দিয়ে একটি কার্ড বানিয়ে গিফট করেছিল। সেখানে লেখা ছিল ‘প্লিজ মা হৃদয়ের জানালাটা খোলোনা’। সে চলে যাওয়ার পরে একটি মা দিবস পার হয়েছে। দিয়া তো আমাকে কিছুই গিফট করেনি। রান্না করতে, খেতে, শুতে সবসময়ই আমি দিয়াকে দেখতে পাই। খুঁজে ফিরি। দিয়া বড় হয়ে আইনজীবী হতে চেয়েছিল। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না।

দিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মেয়ে চলে যাওয়ার পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছি গাড়ির স্টিয়ারিং- এ আর হাত দিব না। এখন আর গাড়ি চালাই না। কারণ যে গাড়ি আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে সে গাড়ি আমি চালাবো না। সরকারিভাবে কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলাম। সেই টাকা থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর নিদৃষ্ট পরিমানে যে মুনাফা পাই সেটা দিয়ে বাসা ভাড়া দেই। আর মহাখালী বাস টার্মিনালের পাশে ছোট একটি হোটেল দিয়েছি। সেখান থেকে যা আয় হয় তাই দিয়ে কোনো ভাবে সংসার খরচ চালাচ্ছি। দিয়ার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তার পরেও আমাদের ছোট দিয়াকে দেখে বড় দিয়াকে হারানোর কষ্ট ভোলার চেষ্টা করি। আমিও তো ড্রাইভার। ১৭ বছর ধরে গাড়ি চালিয়েছি। আমার দ্বারা তো কখনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। জাবালে নূরের দুই চালক ছিলেন অদক্ষ। তারা ড্রাইভার নামে কলঙ্ক। তাদের যাবজ্জীবন সাজা দেয়ায় আমি ও আমার পরিবার অনেক খুশি।

দিয়ার বড় বোন রোকেয়া খানম রিয়া বলেন, রাতে ঘুমাতে পারি না। আমি আর দিয়া একই খাটে ঘুমাতাম। দিয়ার বিছানা এখন শূন্য পড়ে আছে। প্রায় রাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানায় বসে কাঁদি। দিয়া চলে যাওয়ার পর থেকে মা সারা দিন কান্না করে। ছোট যে বাবু (বোন) তাকে আমি আর আব্বু দেখাশোনা করি। ওকে আমরা কখনো মীম কখনো দিয়া বলে ডাকি। ছোট দিয়া আমার কাছেই থাকে। ও আসার পর বাসায় কিছুটা হলেও আমরা প্রাণ ফিরে পেয়েছি।

অন্যদিকে ওই দূর্ঘটনায় নিহত আবদুল করিম রাজীবের মা মহিমা বেগম অন্যের মুখের অবয়বে খোঁজে ফেরেন রাজীবকে। থাকেন অন্যের বাড়িতে। স্বামীর বা পৈত্রিক কোনো সম্পত্তি নেই যেখানে তিনি থাকবেন। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই অন্যের বাড়ি পাহারা দেন এবং নিজে থাকেন। প্রায় এক যুগ আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় রাজীবের বাবা। তিনি হোটেলে কাজ করতেন। স্বামী মারা যাওয়ার পরে চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় মহিমা বেগমের জীবন যুদ্ধ। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। রাজীব তার খালাতো ভাইয়ের উত্তরার বাসায় থেকে পড়ালেখা করতেন। বর্তমানে তার ছোট ভাই ঢাকায় বোনের বাসায় থেকে পড়ালেখা করেন। রাজীবের খালাতো ভাই মেহরাজউদ্দিন বলেন, খালার শরীর ভালো নেই। সরকারি ভাবে যে আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছিলেন প্রতি তিন মাস পর সেটার মুনাফা তুলতে তিনি ঢাকা আসেন। আদালতের রায়ের খবর শোনার পর থেকেই তিনি অসুস্থ। আমরা এই রায়ে সন্তুষ্ট না। আমাদের প্রত্যাশা ছিল মৃত্যুদণ্ড। শুনেছি মামলার রায়ে যাবজ্জীবন সাজা হওয়া দুই বাস চালক আপিল করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি থাকবে এই সাজা যেন বহাল থাকে। এছাড়া রাজীব মারা যাওয়ার পর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায় সরকারিভাবে দুই একর জমি দেয়ার কথা ছিল আমার খালাকে। কিন্তু সেটা এখনো ঝুলে আছে। রাজীবের মা নিতান্তই দরিদ্র। তার মাথা গোঁজার ঠাই নেই। এই জমিটা পেলে খালা হয়তো ছোট ছেলেকে নিয়ে শেষ জীবনটা একটু ভালো ভাবে কাটাতে পারবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status