প্রথম পাতা

ভাই, আমার বোনকে বাঁচান

রোকনুজ্জামান পিয়াস

৩ ডিসেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:১৩ পূর্বাহ্ন

সহোদর ভাইবোন। দু’জনই সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। ভাই তিন বছর হলো সেখানে কাজ করছেন। আর নিষেধ সত্ত্বেও বড় বোন গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে দেশটিতে গেছেন ৭ মাস আগে। দালালের মোটিভেশনের কাছে হার মেনেছে ভাইয়ের নিষেধও। কিন্তু দেশটিতে যাওয়ার পর থেকেই বর্বর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তিনি। যেদিন সৌদি আরবে পা দিয়েছিলেন, সেদিন থেকেই নির্যাতন চলছে তার ওপর। নির্যাতনের শুরুটা সেদেশে থাকা এক বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে।

ওই দালাল বিমানবন্দর  থেকে রিসিভ করে প্রথমদিনই তাকে নির্যাতন করে। তার অধীনে রাখা হয় তিনদিন। এরপর প্রথম মালিক। সেখান থেকে হাত বদলে তার ঠিকানা হয় দ্বিতীয় মালিকের কাছে। কিন্তু নির্যাতন থেমে থাকেনি। ওই মালিকের ৭৫ বছর বয়সী বাবা প্রতিদিনই তাকে নির্যাতন করছে। ইলেক্ট্রিক শক, মাথার চুল কেটে দেয়াসহ নানান ধরনের নিপীড়ন চলছে তার ওপর। একই দেশে অবস্থান করলেও অসহায় সহোদর ভাই। পাশবিক নির্যাতনের শিকার বোনকে উদ্ধার করতে পারছেন না তিনি। উল্টো এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে বোনের গৃহকর্তা। এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করতে পারছেন না তার নিজের মালিকও। এদিকে সংশ্লিষ্ট দালাল তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনতে আড়াই লাখ টাকা দাবি করেছে। এই অবস্থায় বোনকে উদ্ধার করতে না পেরে নীরবে কাঁদছেন একই দেশে বাস করা অসহায় ভাই, দেশে থাকা স্বজন-সন্তানেরা। সেই ভাই ফোন করে এই প্রতিবেদকের করুণ আর্তি জানান। বলেন- ভাই, আমার বোনকে বাঁচান। যেভাবেই হোক দেশে ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করেন। না হলে সে মারা যাবে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণও করেন তিনি।

জানা যায়, ওই নারীর নাম শামীমা বেগম। বাড়ি সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার গোরারাং ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামে। ৫ সন্তানের জননী শামীমার স্বামী ৫-৬ বছর আগে তাকে ছেড়ে আরেকটি বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন। বাবা মারা গেছেন আরো আগে। এই অবস্থায় বাবার বাড়িতে ৫ সন্তান নিয়ে মায়ের আশ্রয়ে ছিলেন তিনি। বছরখানেক আগে মাও মারা গেছেন। অসহায় শামীমা তার সন্তানদের নিয়ে ভাইদের সংসারেই ছিলেন। এই অবস্থায় দালাল ইসলাম উদ্দিনের খপ্পরে পড়েন তিনি। ইসলাম উদ্দিন তাকে ভালো কাজের কথা বলে সৌদি যাওয়ার প্রলোভন দেখায়। সন্তানদের কথা চিন্তা করে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সৌদিতে অবস্থানরত তার আরেক ভাই তাকে নিষেধ করেন। তিনি নারী কর্মীদের বর্তমান বাস্তবতার কথা বোঝান। তবে দালালের মোটিভেশনের কাছে তার এ বোঝানোয় কাজ হয় না। বাধ্য হয়ে তিনি ইসলাম উদ্দিনকে ফোন করেন। এতে ক্ষুব্ধ হন। ইসলাম উদ্দিন শামীমার ভাইকে হুমকিও দেন। এ ছাড়া গোপনে শামীমাকে বিদেশ পাঠিয়ে দেন। গত ৭ মাস আগে তাকে সৌদি আরব পাঠানো হয়। এরপর দীর্ঘদিন খোঁজ ছিল না শামীমার। পরিবারের কেউ যোগাযোগও করতে পারেনি তার সঙ্গে। মাস তিনেক আগে শামীমা বাড়িতে ফোন দিয়ে তার দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। তার ওপর নির্যাতনের কথা বলেন।

স্বজনরা সৌদিতে থাকা তার ভাইয়ের নম্বরটি দেন। এর কয়েকদিন পর ভাইকে ফোন দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শামীমা। তারা তাকে বাঁচানোর আকুতি জানায়।
শামীমার বরাত দিয়ে একই দেশে থাকা তার ভাই গতকাল বলেন, তার বোনকে সৌদি বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করেন নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলী এলাকার দেলোয়ার পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তি। তিনি শামীমাকে নিয়ে তিনদিন নিজের কাছে রাখেন। ওই সময় প্রতিদিনই তাকে নির্যাতন করতো দেলোয়ার। এরপর রিয়াদের আলকারিজ সিটির একটি বাড়িতে কাজে দেয়া হয়। কিন্তু ভাষা না বোঝায় এবং কাজ না পারায় তার বোনকে গৃহকর্তা মারধর করতো। কয়েকদিন পর ওই মালিক তাকে মক্তবে দিয়ে আসে। এর দু’দিন পর আবারো তাকে নিয়ে যায় ওই মালিক। এরপর তিনি আরেক মালিকের কাছে বিক্রি করে দেন। ওই বাসায়ও তার ওপর নির্যাতন চলতে থাকে। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো, ওই বাসায় ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধ রয়েছে যে তাকে প্রতিদিনই নির্যাতন করে। শামীমার ভাই বলেন, তার বোনের কাছে কোনো মোবাইল নেই। একদিন লুকিয়ে ফোন করে। বলে- ভাই, পারলে আমাকে বাঁচা। এরপর আর কখনো ফোন করেনি। আমি ফোন করে তাদেরকে অনুরোধ করি, তার ওপর নির্যাতন না চালানোর জন্য। কিন্তু এরপর থেকে তারা নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। নিজের ভাই বলে পরিচয় দিলেও মানেননি তারা। উল্টো হুমকি দিয়ে বলে, ‘তুই ওর বয়ফ্রেন্ড। আবার ফোন করলে পুলিশে দেবো।’ আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেবে বলেও হুমকি দেয়। সেদেশে থাকা দেলোয়ার দালালের কাছে ফোন করলে সেও একই হুমকি দেয়। শামীমার ভাই তার নিজের মালিককেও বিষয়টি জানান। তার কাছে সাহায্য চান। কিন্তু মালিক নিজে চেষ্টা করেও তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। পরে মালিক বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বোনকে উদ্ধারের পরামর্শ দেন।

শামীমার ভাই জানান, তার বোন নিরক্ষর, নামও সই করতে পারেন না। এদেশে কি করবে? এজন্য আমি নিজেই তাকে নিষেধ করেছিলাম। দালাল ইসলাম উদ্দিনকে না পাঠানোর জন্যও অনুরোধ করেছিলাম। উল্টো ইসলাম উদ্দিন আমাকে হুমকি দেয়। আর গোপনে বোনকে পাঠিয়ে দেয়। তিনি বলেন, উপায় না পেয়ে আমি ওই বাসা থেকে বোনকে সুযোগ বুঝে পালিয়ে যেতে বলেছিলাম। একদিন পালিয়েও যায়। পুলিশ তাকে আটক করে। কিন্তু মালিক আবারো সেখান থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। এরপর থেকে নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়েছে। তাকে ইলেকট্রিক শক দেয়, মাথার চুল কেটে দিয়েছে। মোবাইল চাইলে যৌন নির্যাতনের শর্তে কথা বলতে দেয়। শামীমা যে বাড়িতে আছেন, সেখান থেকে রিয়াদস্থ বাংলাদেশি দূতাবাসের দূরত্ব ৮০-১০০ কিলোমিটার। আর শামীমার ভাই থাকেন জেদ্দা এলাকায়।
গতকাল কথা হয় দেশে থাকা শামীমার ছোট বোনের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত মে মাসে তার বোন সৌদি যায়। এরপর সাড়ে তিন মাস তার কোনো খোঁজখবর পাইনি। তাকে সেদেশে পাঠানো ঢাকার ভেলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সির প্রতিনিধি সুনামগঞ্জের ইসলাম উদ্দিনের কাছে গিয়ে বোনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি খারাপ ব্যবহার করেন। বলেন, আমার দায়িত্ব বিদেশ পাঠানো, পাঠিয়ে দিয়েছি, আর কোনো দায়িত্ব নেই। এ সময় বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ইসলাম উদ্দিন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। বলেন, এই টাকা দিলে বোনকে ফেরত এনে দেবেন। শামীমার বোন বলেন, এত টাকা আমরা কোথায় পাবো। ৫টি সন্তান ছাড়া তার কিছু নেই। স্বামী-সম্পত্তি কিছুই নেই তার। তিনি বলেন, তার বোন এক-দেড় মাস পরপর গোপনে ফোন করে। খুব ভয়ে ভয়ে কথা বলে। দু’একদিন ভিডিও কল দিয়ে তার শরীরের নির্যাতনের ক্ষত দেখিয়েছে।
এ ব্যাপারে ভেলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সির প্রতিনিধি মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, শামীমা আপাতত ভালোই আছে বলে জানি। তাকে এজেন্সি থেকে তেমনটাই জানানো হয়েছে। তার ছোট ভাই রাহুলও বিষয়টি জানে। শামীমা এখন দেশে ফিরতে চায় না। এ ছাড়া আড়াই লাখ টাকা দাবির বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি। বলেন, প্রথম যখন এজেন্সিকে ফেরত আনার কথা জানিয়েছিলাম, তারাই ওই টাকা চেয়েছিলো। এ ছাড়া এখন ফেরত আনার বিষয়টি এজেন্সির হাতে নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ব্যাপারে শামীমার স্বজনরা বলেন, রাহুল অফিসে গেলে মালিককে সামনে রেখে শামীমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। ভয়ে সে মিথ্যা কথা বলে। না হলে তাকে মেরে ফেলবে। পরে যখন লুকিয়ে আবার ফোন দেয়, তখন মারধর, নির্যাতনের কথা বলে। বলে, মালিকের সামনে সত্য বললে তাকে বাঁচতে দেবে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status