প্রথম পাতা

‘আইন সংশোধনে জনস্বার্থ যেন রক্ষা হয়’

শুভ্র দেব

২৩ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৯:২১ পূর্বাহ্ন

নতুন সড়ক আইনের যে সকল ধারাকে কঠিন মনে করছেন সেগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদের নেতারা। বুধবার সারা দেশে পরিবহন শ্রমিকরা দিনভর কর্মবিরতির পর রাত ৯টায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জান খান কামালের বাসায় বৈঠক করেন মালিক-শ্রমিক নেতারা। বৈঠকে তারা নতুন আইন সংশোধনের জন্য ৯ দফা দাবি জানিয়েছেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগামী বছরের জুনমাস পর্যন্ত নতুন আইনটি প্রয়োগ বন্ধ ও মালিক-শ্রমিকের দাবিগুলো সুপারিশ আকারে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা বলেছেন। নতুন সড়ক আইনের কয়েকটি ধারাকে পরিবহণ শ্রমিকের জন্য অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করে সেগুলোকে সংশোধনের কথা বলেছেন পরিবহণ, দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ ও নগরবিদরা। এছাড়া নুতন আইনের কিছু ধারার সঙ্গে তারা একমত ও কিছু ধারায় দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। সর্বোপরি জনগণের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন।

ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিউিটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, নতুন আইনের বিপরীতে যে দাবিগুলো আসছে সেগুলোর সঙ্গে আমি কিছুটা একমত আবার কিছুটা দ্বিমত। যেমন তারা যানবাহনের কারিগরি পরিবর্তনের নিয়ে তারা যে দাবি জানিয়েছে আমি বলবো সেগুলো অযৌক্তিক। কারণ অনেকেই যানবাহনের বডি আকারে বাড়িয়েছেন। এগুলো ঠিক করে ফেলা উচিত। এছাড়া কাগজপত্র না থাকার কারনে জরিমানা কমানোর বিষয়টিও অযৌক্তিক। তবে জামিন অযোগ্যতার যে ধারা দেয়া হয়েছে সেটি তারা সংশোধন বা বাতিল চেয়েছেন। তাদের এই দাবি যৌক্তিক। কারণ একটি দুর্ঘটনা শুধু চালকের কারণে হয় না। এখানে অন্য কারণও থাকতে পারে। এখন দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে যদি চালককে জেলে পাঠানো হয় আর সে যদি জামিন না পায়। এক বছর পর প্রমাণ হলো চালকের কোনো দোষ নাই। তাহলে এই এক বছর চালককে বিনা দোষে জেলে কাটতে হবে। কারণ আমাদের দেশে বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে জামিনঅযোগ্য ধারা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না। বিচারক যদি মনে করেন ওই আসামিকে জামিন দিলে বিচার প্রক্রিয়াটাকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে তিনি তাকে জামিন দিবেন না। কিন্তু ধারাটা জামিনযোগ্য হওয়া দরকার। আর জরিমানার ক্ষেত্রে আহামরি কোনো সংশোধন আনার সুযোগ নাই। তিনি বলেন, যাদের কাগজপত্র, ফিটনেস অন্যান্য কাগজপত্র ঠিক থাকবে তাদের এত ভয় পাওয়ার কিছু নাই। পুলিশ যাতে হয়রানি না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

নগরবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, আইন করা হয়। কিন্তু সেটি প্রয়োগ ব্যাহত হয়। কারণ এখানে নানা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে। কেউই ছাড় দেয় না। সরকারকে বাধ্য হয়েই শক্ত আইন করতে হয়। কিন্তু সেটি প্রয়োগের ক্ষমতা আছে কিনা সেটি বুঝতে হবে। আইনে কিছুটা ছাড় দেয়া যায়। তবে বেশি দেয়া ঠিক হবে না। আইন আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। আলাপ আলোচনা আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। শ্রমিক নেতা, মালিক নেতাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে সরকার বারবারই বসে। শেষ পর্যন্ত তারা কিছুই মানছে না। তিনি বলেন, এটা একটি কঠিন প্রক্রিয়া। আলোচনা করে বুঝাতে হবে এটি সবার জন্যই প্রয়োজন। খুব বেশি কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও মুশকিল। শ্রমিক ও মালিকদের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের দায়িত্ব হল আইন নিজে বুঝা আবার বুঝিয়ে দেয়া। এখন যদি বুঝানো হয় এই আইন স্বার্থবিরোধী তবে আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন আন্দোলনের কারনে সরকারের ওপরও একটা চাপ আছে। আবার শ্রমিকরাও একটি বড় শক্তি। সমাধান খুব সহজ নয়। মধ্যস্ততা দরকার। শুধু আইন করে হবে না। আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। সব পক্ষেরই একটা নমনীয় মানসিকতা দরকার। কারণ সবার ওপরে জনস্বার্থ। একজন শ্রমিকও এক সময় পথচারি হয়। তাই দুই দিকই বিবেচনায় আনা দরকার। জামিন অযোগ্য অপরাধের যে ধারা দেয়া হয়েছে সেটিও আলোচনা সাপেক্ষ সংশোধন করা যেতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইন্সটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, আইনটাকে আরো শিথিল করলে ভাল ছিল। হঠাৎ করে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা জামিন অযোগ্য অপরাধ এগুলো তড়িঘড়ি না করে প্রাথমিকভাবে যাছাই করে আরেকটু সময় নিয়ে করা যেত। একটি দুর্ঘটনা শুধু চালকের কারণে হয় না। চালকের জন্য পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা একটু বেশি হয়ে যায়। দুর্ঘটনা ঘটার পরে একটি তদন্ত করে ঠিক করা উচিত ছিল তার কি পরিমাণ শাস্তি হবে। এক্ষেত্রে মালিককেও জরিমানা করা দরকার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ৯ দফা দাবি নিয়ে তিনি বলেন, তাদের দাবি কিছুটা মেনে নেয়া দরকার। পাশপাশি আইনটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করার আগে দুর্ঘটনাকে প্রভাবিত করে এই বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নেয়া দরকার ছিল। যেমন চালকের আচরণগত পরিবর্তন, প্রশিক্ষণ, নতুন চালক তৈরি করা, পথচারী ও মালিকদের সচেতন করা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চালকরা দায়ী। কারণ আমাদের সিস্টেমটা স্ট্যান্ডার্ড না। চালক তৈরির সময়ই গলদ থাকে। এই জায়গাগুলো আগে সমাধান করতে হবে। তারপর আইন প্রয়োগ করা সহজ হবে। এছাড়া দুর্ঘটনা ঘটার পর তদন্ত করবে রিপোর্ট দিবে পুলিশ। এটাও একটা সমস্যা। কারণ পুলিশের ওপর আস্থা কম। তারা ম্যানেজড হয়ে রিপোর্ট দিতে পারে। দুর্ঘটনা ঘটার পর এক্সিডেন্ট রিচার্স ইন্সটিউটের গবেষনার পাশপাশি চিকিৎসকসহ আরো কিছু কিছু ডিপার্টমেন্টের সম্পৃক্ততা থাকা দরকার।

আইনের ভেতরে দুর্ঘটনা ঘটার পর কে তদন্ত করবে, কেমন কমিটি হবে। এজন্য এই আইন প্রয়োগ করতে একটু ঝামেলা হবেই। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করে আইন সংশোধন ও পাশপাশি অন্য বিষয়গুলোকে একটা স্ট্যান্ডার্ডের মধ্য নিয়ে আসবে। আমার সড়কগুলোও এত বেশি নিরাপদ না। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তাই বলে চালকরা এত টাকা জরিমানা দিতে পারবে না। এই পরিমান টাকা মালিকদের করলে তারা হয়তো দিতে পারবে।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে তিনি বলেন, আইন করা বা প্রয়োগ করা একটি জঠিল বিষয়। একটা পক্ষকে খুশি করার জন্য বা তাদের দাবি মেনে নেয়ার জন্য যে দ্রুততম সময়ে এই আইন সংশোধন করতে হবে এটি ঠিক হয়নি। দাবি থাকবে। আর আইনতো আগেও ছিল। সেটিও পুরোপুরি প্রয়োগ হয় নাই। আগের আইন প্রয়োগ না হওয়ার কারণেই দুর্ঘটনা বেড়েছিলো। যারা এই আইনের সঙ্গে জড়িত তাদের নিয়ে বারবার বসা দরকার ছিল। এজন্য তাদের সব কথাই শুনতে হবে বিষয়টা এমন না। সবকিছুতেই একটা যুক্তি থাকতে হবে। অযৌক্তিক, অবাস্তব বিষয়ই সমস্যা তৈরি করে।

পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন সড়ক আইনের ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৮৪, ৮৬, ৯০, ৯৮, ও ১০৫ ধারার পরিবর্তন চেয়েছেন। মালিক-শ্রমিক নেতারা বলেছেন এসব ধারার ৮৪, ৯৮ ও ১০৫ ধারার মামলাটি সবচেয়ে কঠিন করা হয়েছে। বড় অংকের জরিমানার পাশপাশি এই অপরাধে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। তাই জরিমানা কমানোসহ এসব অপরাধ জামিনযোগ্য করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status