শেষের পাতা

পিয়াজ বীজের বাজারেও আগুন কেজি ২০০০ টাকা

জাবেদ রহিম বিজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে

২৩ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৯:০৮ পূর্বাহ্ন

রফিক মিয়ার ইচ্ছে ছিল অন্যবারের চেয়ে এবার পিয়াজ চাষ বাড়িয়ে করার। ৫ শতক জমিতে মরিচ লাগিয়েছেন, ফুলকপি ৩ শতকে, ধনিয়া ৫ শতকে, বেগুন ১০ শতকে, আলু লাগিয়েছেন ৫ শতকে, রসুন ১ শতকে, মিষ্টি কুমড়া লাগিয়েছেন ২ শতকে। সবচেয়ে কম আধা শতক জায়গায় লাগিয়েছেন পিয়াজ। অথচ এর আগের বছর এক শতক জায়গায় পিয়াজের আবাদ করেছিলেন তিনি। এ থেকে উৎপাদিত পিয়াজে সারা বছর চলেছে তার। পিয়াজ কিনতে হয়নি। কিন্তু এবার পিয়াজের দাম বেশি হওয়ায় ভেবেছিলেন পিয়াজের চাষই করবেন বেশি করে। কিন্তু পিয়াজের বীজ কিনতে গিয়ে চাষের আগ্রহ হারিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিন্দুউড়ার এই কৃষক। পিয়াজের দামের আগুনের প্রভাব পড়েছে বীজে। আগুন এখানে আরো অনেক বেশি। রফিক মিয়ার মতোই ওই এলাকার অনেক কৃষকের এবার বেশি পরিমাণ জায়গা নিয়ে পিয়াজ চাষের ইচ্ছে-আগ্রহ মার খেয়েছে বীজের দামের উত্তাপের কারণে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাজারে দু-সপ্তাহের ব্যবধানে পিয়াজ বীজের দাম বেড়েছে ১২শ টাকা।

শহরের বাজারে যে বীজ বিক্রি হচ্ছে ১৬/১৭শ’ টাকা, তা গ্রামের বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকায়। এই এলাকার কৃষকরা সাধারণত পিয়াজের গোটা (কন্ধ) লাগিয়ে পিয়াজ ফলান। সেই গোটারও সংকট। গত বছর এক কেজি গোটার দাম যেখানে ছিল ৩০-৩৫ টাকা তা এখন ২৬০ টাকা। বীজ আর কন্ধের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সরজমিনে অনুসন্ধানে মিলেছে এই তথ্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ৫৬০ হেক্টর জমিতে পিয়াজ আবাদ হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এই লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৩৫ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে পিয়াজ। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ১ হেক্টর, সরাইলে ২০ হেক্টর, কসবায় ১০ হেক্টর, নবীনগরে ২৭ হেক্টর, বাঞ্ছারামপুরে ৪০ হেক্টর, নাসিরনগরে ৩০ হেক্টর, আখাউড়ার ১ হেক্টর, আশুগঞ্জে ৫ হেক্টর ও বিজয়নগরের ১ হেক্টর জমিতে পিয়াজ আবাদ হয়েছে এখন পর্যন্ত। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে পিয়াজের আবাদ শুরু হয়েছে এখানে। আবাদ চলবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পিয়াজ উৎপাদন হয় না। কৃষকরা খাওয়ার জন্য পিয়াজ আবাদ করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জগতবাজারে বীজ বিক্রির একটি বড় দোকান মেসার্স বিছমিল্লাহ বীজ ভান্ডার। গতকাল শুক্রবার ওই দোকানে খোঁজ নিলে দোকান মালিক মো. জীবন মিয়া ও হেলিম মিয়া জানান, দু’সপ্তাহের ব্যবধানে পিয়াজের বীজের দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। যে বীজ ছিল ৭/৮শ’ টাকা কেজি সেই বীজ হয়েছে ১৫/১৬শ’ টাকা। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মেটাল এগ্রো লিমিটেডের মেটাল সিডের একটি ইনভয়েসে দেখা যায়, ১৯শে নভেম্বর আধা কেজির প্রতি এক প্যাকেট বীজ কিনেছেন তারা ৮শ’ টাকা করে। ৪টি প্যাকেটে মোট ২ কেজি বীজ কিনেছেন ৩২শ’ টাকায়। ওই ইনভয়েসে কোনো কমিশন হবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। ওই বীজ ব্যবসায়ীরা জানান, এর আগে ১৭ই নভেম্বর ১৫শ’ টাকা কেজিতে বীজ কেনেছেন। জানান, বীজের দাম বেশি হওয়ায় এবং চাহিদা থাকায় তারা আমাদের কমিশন দেয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। তারা আরো জানান, লাল তীরের বীজের দাম সবচেয়ে বেশি। তাদের দুই ধরনের বীজ রয়েছে। যার কোম্পানি রেট ১৬শ ও ১৮শ টাকা এখন। এছাড়া মাসুদ সিড, মোমিন সিড এবং ইউনাইটেড সিডের পিয়াজ বীজ প্রতি কেজি ১২শ থেকে ১৫শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। জীবন মিয়া জানান, অন্যান্য বারের চেয়ে এবার বীজের চাহিদা বেশি। গত বছর তারা সবমিলিয়ে ২০ কেজি পিয়াজ বীজ বিক্রি করতে পিরেছিলেন। এবার ৫০ কেজি বীজ এনেছেন। এরইমধ্যে ৩০ কেজি বিক্রিও হয়ে গেছে। আলী বীজ ভান্ডারের আলী মিয়া জানান, আগে মৌসুমে আধা কেজি বীজও বিক্রি করতে পারতেন না। এখন পর্যন্ত দেড় কেজি বীজ বিক্রি করেছেন। অন্যদিকে জেলা শহর থেকে ১২-১৩ কিলোমিটার দূরত্বের একটি গ্রামের হাটে বৃহস্পতিবার দেখা গেছে ২ হাজার টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে পিয়াজের বীজ।

সপ্তাহের দু-দিন বৃহস্পতি আর রোববার বসে নবীনগর উপজেলার বড়াইলের এই হাট। আশেপাশের মানুষ এই হাট থেকেই গোটা পিয়াজ কিনে নিয়ে আবাদ করেন তাদের জমিতে। কিন্তু বৃহস্পতিবার ওই হাটে গিয়ে গোটা পিয়াজ পাওয়া যায়নি। হাটের খোলা জায়গায় নানা ধরনের প্যাকেট ভর্তি বীজ বিক্রি করছেন ৪ ব্যবসায়ী। এরমধ্যে পিয়াজের বীজের প্যাকেট প্রদর্শন করা আছে। তাদের একজন হাসেন মিয়া জানান- ১৪শ টাকা কেজিতে পিয়াজের বীজ কিনে এনেছেন। এখন ১৮শ টাকায় বিক্রি করছেন। তবে এর আগে এক ক্রেতার কাছে ২ হাজার টাকা কেজি দরে পিয়াজ বিক্রি করতে দেখা যায় তাকে।

নবীনগর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পাশে সিন্দুউড়া গ্রামে নিজের জমির দিকে কাচি হাতে ছুটছিলেন রফিক মিয়া। পিছু নিয়ে তার সঙ্গে জমিতে গেলে জানান, একসময় মুদি দোকান চালিয়েছেন। এরপর রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কয়েক বছর করছেন কৃষিকাজ। নানা শাকসবজির চাষ করে বিক্রি করেন। বছরে নিজে খাওয়ার চাহিদা মিটিয়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা আয় হয়। বাড়ির উঠোন, বাড়ির চারপাশে খালি জায়গা এবং জমিতে আবাদ করে চলেছেন নানা ফসল। রফিক মিয়া বলেন, এবার ৩০ শতক জায়গায় পিয়াজ লাগানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু গোটা পিয়াজ আড়াইশ’ টাকা কেজি। গোটা কিনতেই লাগে অনেক টাকা। কি করে পিয়াজ লাগাই। গত বছর একমণ পিয়াজ উৎপাদন হয়েছিল তার আধা শতক জমিতে। এতে সারা বছর চলেছে তার। ওই গ্রামের দক্ষিণ পাশের ফসলের মাঠে কথা হয় আরো অনেকের সঙ্গে। সবাই হা-হুতাশ করেন বীজ আর গোটা পিয়াজের দাম ও সংকট নিয়ে। গৃহবধূ শিরিনা বেগমের সঙ্গে দেখা হলে জানান, আড়াইশ’ টাকা দিয়ে আধা কেজি গোটা পিয়াজ কিনে এক শতক জায়গায় লাগিয়েছি। হুমায়ুন মিয়া গত ২-৩ বছর ধরে পিয়াজের চাষ করছেন। ক’দিন আগে দেড়শ’ টাকা করে দু-কেজি গোটা পিয়াজ এনে লাগিয়েছেন। জানান, এখন এই গোটার দাম ২৬০ টাকা। সে কারণে আরো পরিমাণ জমিতে পিয়াজ আবাদের ইচ্ছে বাদ দিয়েছেন তিনি।

শাহ আলম,সাচ্চু মিয়া, এরাও জানিয়েছেন- গোটা বীজের চড়া মূল্যের কারণে বেশি পরিমাণ জমিতে পিয়াজের আবাদ করেননি। গোটা পিয়াজের দাম বৃদ্ধি ও সংকটের কারণে কৃষকরা পিয়াজের বীজের দিকে  ঝোঁকেন। কিন্তু সেখানে গিয়েও হতাশ হতে হয়েছে তাদের। ফলে এই এলাকার কৃষকরা আগে যতটুকু জমিতে পিয়াজ আবাদ করেছেন এবার তা নাও হতে পারে। সরজমিনে ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে কেউ কেউ নামকাওয়াস্তে একচিলতে জায়গায় পিয়াজ লাগিয়েছেন। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আবু নাছের জানান, তারা যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন তা অর্জিত হবে। তিনি বলেন, এই অঞ্চলের কৃষকরা গোটা পিয়াজই আবাদ করেন বেশি। তবে চর এলাকায় বিশেষ করে মেঘনা নদীর পাড়ে যেমন বাঞ্ছারামপুর, নবীনগর, নাসিরনগর এবং আশুগঞ্জে বীজ দিয়ে পিয়াজ আবাদ করা হয়। তিনি আরো জানান- বিজয়নগর উপজেলার এক একর জমিতে গোটা পিয়াজ উৎপাদনের জন্য প্রযুক্তি সহায়তাসহ বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করেছেন তারা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status