এক্সক্লুসিভ

সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার সুমি

যেভাবে কাটছে দিনরাত

পঞ্চগড় প্রতিনিধি

২৩ নভেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৭:৪০ পূর্বাহ্ন

সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মী সুমি আক্তার (২৫) বাবার বাড়িতে ফিরে এসে ঘরকুনো হয়ে পড়েছেন। চোখের চিকিৎসা শেষে বর্তমানে বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। লজ্জায় কারো সঙ্গে দেখা ও কথা বলছেন না। গণমাধ্যমকর্মীদেরও এড়িয়ে চলছেন। সে সঙ্গে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে তার দিন কাটছে বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে। গত শুক্রবার বিকালে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের  বৈরাতি সেনপাড়া এলাকার বাবা- মা’র কাছে সুমিকে হস্তান্তর করেন। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের গাড়িতে করে তাকে নিয়ে আসা হয়। সুমির মা মল্লিকা বেগম বলেন, সুমিকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর তার স্বামী ঢাকা থেকে এসেছিল। আমরা চাই না, তার সঙ্গে সুমি ফিরে যাক।

সুমিরও সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সুমি বাড়ি থেকে দুই বছর আগে গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়েছিল। এর পর তার বিয়ে ও বিদেশ যাওয়া নিয়ে আমরা কিছুই জানতাম না। সে অসুস্থ থাকায় তার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে পারিনি। সে কারো সঙ্গে কথা বলতে চায় না। সুমির খালা জোলেখা বেগম বলেন, আমরা এই মুহূর্তে সুমিকে কোনো মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে দিতে চাই না। আর সুমিও কথা বলতে চায় না বলে আমাদের জানিয়েছে। সারাদিনে আশপাশের গ্রামের লোকজন দল বেঁধে সুমিকে দেখতে আসছে। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। আমরা গরিব হলেও মান-সম্মান তো আছে। আমরা চাই না আমাদের মেয়ের সমস্যা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি হোক। সুমির প্রতিবেশী দাদা (বাবার মামা) লাল মিয়া বলেন, সুমি ঢাকায় গিয়ে কোনো প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সৌদি আরবে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়। সরকারিভাবে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। এতে আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে এই এলাকায় তো আমাদের বাস করতে হবে। মেয়েটার তো লোকলজ্জা আছে।

এজন্যই সে চায় না কারো সঙ্গে কথা বলতে। মানুষ তো বুঝে না সবাই দল বেঁধে দেখতে আসছে। সুমির স্বামী নুরুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, সুমি দেশে ফেরার সময় আমার সন্তানদের নিয়ে আমি বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সুমি সেখানে আমার সঙ্গে দেখা না করেই বাবার বাড়িতে চলে আসে। এজন্য আমি আমার দুই সন্তান ও আমার প্রয়াত স্ত্রীর খালাকে নিয়ে শুক্রবার রাতে সুমিদের বাড়িতে যাই। সেখানে সুমির পরিবারের লোকজন আমাদের খাওয়া দাওয়া না দিয়ে একটা ঘরে আটকে রাখে ও মারধরের চেষ্টা করে। পরে শনিবার আমি সন্তানদের নিয়ে কোনো মতে তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসি। ওরা সুমির সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেয়নি। তারা আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে সুমিকে তালাক দিতে বলে। নুরুল বলেন, আমার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সুমিকে বিয়ে করি। আগের স্ত্রীর দুই ছেলে আছে। একজনের বয়স ৮ বছর আর একজনের বয়স ৫ বছর। এই দুটি সন্তান সুমিকে মা হিসেবেই জানতো। কিন্তু সুমি আমাকে না জানিয়েই মিরপুরের এক নারীর প্ররোচনায় সৌদিতে চলে যায়। সুমির যেদিন বিদেশে যাওয়ার ফ্লাইট ছিল সেদিনও সে পঞ্চগড়ে তার বাবার বাড়ি থেকেই গিয়েছিল। আমাকে কিছুই  জানায়নি।

সুমির বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়েকে ফিরে পাওয়ার পর ওইদিন রাতেই তার চিকিৎসার জন্য সুমিকে নিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে যাই। সুমির স্বামী শুক্রবার রাতে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু আমি সুমির সঙ্গে তার দেখা করতে দেইনি। তবে তাকে (সুমির স্বামীকে) আটকে রাখা বা মরধরের চেষ্টার কথা অস্বীকার করে বলেন, আমার মেয়ে অসুস্থ। সে একটু সুস্থ হোক তখন ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবো কোনো আইনি সহায়তা নিবো কিনা। আমরা গরিব মানুষ হলেও সমাজে তো আমাদের ?মুখ দেখাতে হবে। সুমি এই মুহূর্তে কারো সঙ্গে কথা বলবে না বলে জানিয়েছে। উল্লেখ্য, পরিবারের অভাব অনটন ঘোচাতে প্রায় দুই বছর আগে সুমি ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসের কাজে যোগ দেন। সেখানেই নুরুল ইসলাম নামে আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ঢাকা যাওয়ার ৬ (ছয়) মাস পর নুরুলকে বিয়ে করেন সুমি। পরে স্বামীর প্ররোচনায় বিয়ের তিন-চার মাস পরেই সৌদি আরবে যান। গত ৩০শে মে তার স্বামী নুরুল ইসলাম সুমিকে ‘রূপসী বাংলা ওভারসিজ’র মাধ্যমে গৃহকর্মী ভিসায় সৌদি আরব পাঠান। সেখানে যাওয়ার পর সৌদি আরবের রিয়াদে প্রথম কর্মস্থলে গৃহকর্মীর কাজ করতেন সুমি। চার মাস থাকার মধ্যে মাত্র এক মাসের বেতন ১৫ হাজার টাকা তার স্বামীকে পাঠান। বিভিন্ন সূত্র মতে, সেখানে বাড়ির মালিক সুমিকে মারধর করতেন। হাতের মধ্যে গরম তেল ঢেলে দেয়াসহ নানাভাবে নির্যাতন করতেন। কান্নাকাটি করার জন্য এক পর্যায়ে তাকে একটি ঘরে বন্দি করে রাখেন। খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই বাড়ির মালিক ইয়েমেন সীমান্তের নাজরান এলাকায় আরেক ব্যক্তির কাছে ২২ হাজার রিয়ালে তাকে বিক্রি করে দেয়। পরে সেখানেও তার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। এ সময় তার ব্যবহৃত মুঠোফোনটিও তারা রেখে দেয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সুমি তার স্বামীর সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। অনেক অনুরোধের পর সুমিকে তার মুঠোফোনটি ফেরত দিলে সুমি শৌচাগারে ঢুকে লুকিয়ে নিজের অবস্থার কথা ভিডিও করে ঢাকায় স্বামীর কাছে পাঠান। পরে সেই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর সরকার সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে সুমিকে উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status