প্রথম পাতা

ভোগান্তি, নৈরাজ্য

স্টাফ রিপোর্টার ও বাংলারজমিন ডেস্ক

২১ নভেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

ধর্মঘটে দীর্ঘক্ষণ আটকা এম্বুলেন্স। ভোগান্তির শিকার নবজাতকও। সাইনবোর্ড এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন আলোকচিত্রী জীবন আহমেদ

দেশজুড়ে পরিবহন ধর্মঘটে দুর্ভোগ ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। গতকাল থেকে পণ্য পরিবহণে ধর্মঘট চলায় পরিস্থিতি আরো জটিল রূপ নিয়েছে। অচল হয়ে পড়েছে বন্দরসহ সারা দেশের পণ্য পরিবহন। বাজারেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগের দুই দিন থেকে চলা যাত্রীবাহী পরিবহন ধর্মঘট আরও নতুন নতুন রুটে বিস্তৃত হয়েছে গতকাল। পরিবহন শ্রমিকদের বাধা ও অবরোধে অনেক সড়কে ব্যক্তিগত যানবাহনও চলতে পারেনি। বিভিন্ন সড়কে যারা গাড়ি নিয়ে বের হন তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। গাড়ির কালি-মবিল মাখিয়ে দেয়া হয় মুখে। ঢাকা থেকে দুর পাল্লার বাস বন্ধ করে দেয়ায় হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। জরুরি প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলেও তারা নির্ধারিত গন্তব্যে যেতে পারেননি। আর রাজধানীতে গণপরিবহন কম থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অনেককে। সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে কাল সকাল ৭টা থেকে দুপুর পর্যন্ত দূরপাল্লার কোনো বাস কোথাও ছেড়ে যায়নি। দুপুরের পর হাতে গুনা কয়েকটি বাস ছেড়ে যায়। সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন প্রায় দুই সহস্রাধিক বাস যাতায়াত করে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। গতকাল সায়দাবাদ গিয়ে দেখা গেছে বাসগুলো স্ট্যান্ডে পার্কিং করে রাখা হয়েছে।

ভোরে বেশ কিছু বাস সিলেট, চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলেও ৭টার পর কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। সৌদিয়া পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার আব্দুর রহিম জানান, সায়েদাবাদ থেকে প্রতিদিন তাদের অন্তত ৩০টি গাড়ি ছেড়ে যায়। কিন্তু অবরোধের কারণে কোনো গাড়ি ছাড়া সম্ভব হয়নি। সায়েদাবাদে অনেক কাউন্টার খোলা থাকলেও দায়িত্বশীল কেউ ছিলেন না। গাড়ি মেরামত ও ধোঁয়ার কাজ করছিলেন পরিবহন শ্রমিকরা। কাউন্টারগুলোতে বসা ছিলেন যাত্রীরা। চট্টগ্রামগামী মোহাম্মদ আরমান জানান, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে চিকিৎসার কাজে ঢাকা এসেছিলেন। গতকালই তাদের চট্টগ্রাম ফেরার কথা। কিন্তু বাস না পেয়ে স্ট্যান্ডে অসহায়ের মতো বসে আছেন। কখন বাস আসবে আর কখন বাড়ি যাবেন। রাত যে ঢাকায় কাটাবেন এমন কোন জায়গাও নেই তাদের। কুমিল্লা থেকে মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন কাপড় ব্যবসায়ী কবির হোসেন। রাতে ছিলেন হোটেলে। সকালে ইসলামপুর থেকে কাপড় কিনে সায়দাবাদ এসে দেখেন কোন বাস নেই। বস্তাভর্তি কাপড় নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। তিনি বলেন, এখানে এসেই দেখি কোন বাস নেই। শুনেছিলাম ট্রাক শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকেছে। মনে করেছি বাস চলবে। কিন্তু স্ট্যান্ডে এসে দেখি উল্টো চিত্র।

এদিকে গতকাল দুপুর দুইটার পর থেকে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল শুরু হয়। বেলা ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে অবস্থানরত পরিবহন শ্রমিকরা সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এর আগে গতকাল সকাল ৭টা থেকে সাইনবোর্ড এলাকায় অবস্থান নিয়ে ধর্মঘট করেছিলেন তারা। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেটসহ আশপাশের সড়কের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে গতকাল দুরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। সকাল থেকেই বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা টার্মিনালে এসে ভীড় করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে কোনো বাস না পেয়ে যাত্রীরা আবার ফিরে যান। সরজমিন দেখা যায়, টার্মিনালে সারিবদ্ধ বিভিন্ন রুটের বাসগুলো রাখা হয়েছে। টিকেট কাউন্টারে তালা ঝুলছে। জরুরি কাজে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিলেটের বালাগঞ্জের সাজু মিয়া এসেছিলেন ঢাকায়। কাজ সেরে গতকালই তাদের সিলেট ফেরার কথা। তাই দুপুর বেলা এসেছিলেন মহাখালী বাস টার্মিনালে। এসে জানতে পারলেন সকাল থেকে দুরপাল্লার কোনো বাসই ছেড়ে যায়নি। বিপাকে পড়ে আবার ফিরে যান হোটেলে। সাজু বলেন, সায়েদাবাদ-মহাখালী বাসটার্মিনাল ঘুরে সিলেটে যাওয়ার কোনো বাসই পাইনি। খোঁজ নিয়েছি ট্রেনের টিকেটও নাই। এখন কিভাবে বাড়ি যাবো বুঝতে পারছি না। ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাবেন কানিজ ইসলাম। সঙ্গে তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ভেবেছিলেন এনা পরিবহনের বাসে করেই যাবেন। কিন্তু কোনো বাস না পাওয়াতে তিনি আর যেতে পারেননি। কানিজ বলেন, বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে কখন যাবো। অনেকদিন পর বিয়ের অনুষ্ঠান। সবাই একসঙ্গে মিলিত হবে। কিন্তু বাসের জন্য যেতে পারছি না। চিকিৎসার জন্য ছোট ভাইকে নিয়ে সোমবার ঢাকা এসেছিলেন হাবিবুর রহমান। গতকালই তাদের টাঙ্গাইলের বাড়িতে ফেরার কথা। কয়েক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে তিনি এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যান।

এনা বাসের চালক শামসুল হক বলেন, সড়ক পরিবহণ আইন বাস্তবায়ন হউক এটা আমরাও চাই। কিন্তু আইনের ধারাগুলো বেশ কঠিন হয়ে গেছে। আমরা চাই ধারাগুলো সংশোধন করার। না হলে আমাদের গাড়ি চালানো সম্ভব হবে না। আইন করা হয়েছে ষোল আনা কিন্তু আইন মানার মত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি। পথচারীরা যত্রতত্র রাস্তা পার হয়। জরিমানা করার বিধান আছে অথচ কাউকে জরিমানা করা হয় না। যদি নিয়মিত পথচারীদের জরিমানা করা হত তবে কেউ যত্রতত্র রাস্তা পার হতো না। যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করার জন্য যানজটের সৃষ্টি হয় অথচ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তাই আমরা চাই আইন থাকবে তবে সেটা সংশোধন করে দেয়া হউক। শাহ ফতে আলী বাসের চালক মো. কামরুল হাসান বলেন, নিরাপদ সড়কের ব্যবস্থা করলে আইন বাস্তবায়ন হবে। আগে পথচারীদের সচেতন, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সড়কে কোনো অবৈধ পার্কিং করতে দেয়া যাবে না। তবেই সরকার যে আইন করবে চালকরা সেটাই মেনে চলবে। যাত্রী মরলে তাদের পরিবার লাখ লাখ টাকা পাবে, কিন্তু চালক মরলে তাদের কি পরিবার পরিজন নাই। একটা দুর্ঘটনা ঘটলে জনগণ এসে চালককে মারধর শুরু করে।

তাই চালকরা মারধরের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাধ্য হয়ে দূর্ঘটনার স্বীকার ওই ভুক্তভোগীর ওপর দিয়েই বাস চালিয়ে পালিয়ে যায়। যদি জনগণ চালককে মারধর না করতো তবে চালকই পুলিশে খবর দিত বা হাসপাতালে নিয়ে যেত। ক্রাউন ডিলাক্স বাসের চালক আব্দুস সাত্তার বলেন, একটা দুর্ঘটনা ঘটলে জরিমানা দিতে হবে আবার জেলও খাটতে হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে ফাঁসি হতে পারে। অথচ এটা নাকি জামিন অযোগ্য অপরাধ। হত্যা মামলার আসামিদের জামিন হয় কিন্তু চালকদের জামিন হবে না। পথচারীরা ভুল করবে আর শাস্তি পেতে হবে আমাদেরকে। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করবে না, ব্যস্ত সড়কে আঙ্গুলের ইশারায় রাস্তা পার হয়ে যাবে। আইন কঠিন করার দরকার আছে তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। সরকার, মালিকপক্ষ, চালকসহ সবাই একসঙ্গে বসে কিছু কিছু জিনিস সংশোধন করলে সবার জন্য উপকার হবে। রহিম নামের আরেক বাসের চালক বলেন, আমরা একটি সুষ্ঠু সমাধান চাই। আইন করার আগে চালকদের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। তা না হলে এই কর্মবিরতি চলবে। নিরালা সুপার বাসের চালক শাহজাহান বলেন, ৮ জন সদস্যর পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী আমি। বাস চালিয়ে পরিবারের সকল চাহিদা মেটাই। দুর্ঘটনায় যদি আমি মারা যাই তবে আমার পরিবারের কি হবে। মাসে যদি চারদিন আমাকে জরিমানা করা হয়।

এদিকে গতকাল তেজগাঁও ট্র্যাক-কাভার্ড ভ্যান টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করছেন। টার্মিনাল থেকে ছোট বড় কোনো ট্র্যাক-কাভার্ড ভ্যান ছাড়েনি। তাই তেজগাঁও রেলক্রসিং থেকে শুরু করে সাতরাস্তা মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে পার্কিং করা রাখা হয় ট্র্যাক-কাভার্ড ভ্যান। রহিম নামের কাভার্ড ভ্যানের চালক বলেন, একটা দুর্ঘটনা ঘটলে সব দোষ চালকের হয়। শুধু কি চালকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে?

এদিকে গতকাল রাজধানীতেও গণপরিবহনের সংখ্যা অন্য দিনের চেয়ে কম ছিল। সরজমিনে দেখা যায়, বাসের অপেক্ষায় যাত্রীদের দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে। ফার্মগেটে ধীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছিলেন ফয়সাল রহমান। গন্তব্য গাজীপুর চৌরাস্তা। কিন্তু কোনো বাস না পেয়ে যেতে পারছেন না। তিনি বলেন, বিআরটিসি ছাড়া অন্য বাস তেমন একটা নেই। দীর্ঘ সময় নিয়ে বিআরটিসি বাস আসলেও যাত্রী ভর্তি থাকছে। চালক এনামুল হক বলেন, বুধবার অফিস-আদালত চলে। এরপরও গুলিস্তান থেকে ফার্মগেট কম সময়ে চলে এসেছি। পথে যানজট নেই। এটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে বাসও কম। বাস নামানোয় অনেকস্থানে চালককে মারধর করা হয়েছে। যে কারণে ভয়ে অনেকে বাস নামায়নি।

তবে বিআরটিসি বাস সচল আছে। সকালে মোহাম্মদপুর থেকে কাওরান বাজার এসেছেন আলামিন নামের একজন যাত্রী। তিনি বলেন, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও বাস পাইনি। তাই রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেল ভাড়া করে আসতে হলো। ভাড়াও বেশি দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, তবে রাস্তায় যানজট না থাকায় খুব দ্রুত চলে এসেছি। ফাহাদ নামের একজন যাত্রী গাবতলী থেকে ফার্মগেটে আসেন সিএনজি অটোরিকশায় করে। তিনি বলেন, বাস না পেয়ে বেশি ভাড়া দিয়ে আসতে হয়েছে। সকালে গাজীপুর থেকে কাওরান বাজার অফিসে আসেন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, সকালে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর একটা বাস পাই। বাসে দাঁড়িয়ে এতো দূরের রাস্তা আসতে হয়েছে।

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাতিলের দাবিতে নারায়ণগঞ্জের সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে ধর্মঘট পালন করেছে পরিবহন শ্রমিক ও চালকরা। এসময় কোন প্রকার যানবাহন চলাচল করতে দেয়নি তারা। ফলে চরম দর্ুভোগে পড়ে যাত্রী সাধারণ এবং পিএসসি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। অনেকে নিরুপায় হয়ে হেঁটে গন্তব্যে গিয়েছেন। অবরোধ চলাকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী যাত্রীদের প্রধান বাহন ছিল ট্রেন। ফলে ট্রেনে ছিল উপচে পড়া ভীড়। দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন শেষে দুপুর ২টার দিকে গণপরিবহন চলাচল শুরু করলে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, সকাল ছয়টা থেকে নারায়ণগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কে গাড়ি রেখে যানচলাচল বন্ধ করে দেয় পরিবহন শ্রমিক ও চালকরা। সড়কে যানবাহন চলাচল করতে  দেখলেই তারা যানবাহন থেকে চালকদের নামিয়ে দেয়। পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। গণপরিবহনের চলাচল বন্ধ থাকায় ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে কার্ভাডভ্যানে করে গন্তব্যস্থলে রওনা হতে দেখা গেছে। শ্রমিকরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর বেশ কিছু গাড়ি এলোমেলো করে রেখে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিক্ষোভ করতে থাকে।

এদিকে, পরিবহন ধর্মঘটে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হতে হয় পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী ও অফিসগামী লোকজনদের। পরিবহন সংকট থাকায় পিএসসি পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বিপাকে পড়েছেন। অনেক পরীক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে ভ্যানে করে ও পায়ে হেঁটে পরীক্ষা কেন্দ্রে  যেতে দেখা যায়।

গতকাল সকালে শহরের ১নং রেলগেট সংলগ্ন নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, চাষাড়া, শিবু মার্কেট, সাইনবোর্ড, শিমরাইল সরেজমিনে গিয়ে  দেখা যায়, ২নং রেল গেট থেকে বন্দর ঘাট সড়কের বিভিন্ন কোম্পানির বাস পার্কিং করে রাখা হয়েছে। টিকিট কাউন্টারগুলো বন্ধ। একই অবস্থা  দেখা যায় চাষাড়া, শিবু মার্কেট, শিমরাইল, সাইনবোর্ড এলাকাগুলোতেও।

শ্রমিকরা জানান, তারা তাদের দাবির প্রতি অবিচল। কিন্তু বুধবার মন্ত্রীদের সঙ্গে শ্রমিক নেতাদের বৈঠকের কারণে আপাতত সাময়িকভাবে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। দাবি না মানলে প্রয়োজনে আবারও অবরোধ করা হবে।
পরে দুপুর ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মনিরুল ইসলাম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তারা ধর্মঘট স্থগিত করে সড়ক থেকে সরে যায়। এরপর থেকে নারায়ণগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মোল্লা তাসলিম হোসেন জানান, নতুন পরিবহন আইন বাতিলের দাবিতে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। সকাল সোয়া ছয়টা থেকে কিছু শ্রমিক রাস্তায় এসে অবস্থান নেয় এবং সড়ক অবরোধ করে মহাসড়কের উভয়পাশ বন্ধ করে দেয়। এসময় তারা সড়কের উপর এলোমেলোভাবে গাড়ি পার্কিং করে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

স্টাফ রিপোর্টার, হবিগঞ্জ থেকে জানান, নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ ৯ দফা দাবিতে সারাদেশের ন্যায় হবিগঞ্জে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক কাভার ভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। গতকাল বুধবার সকাল ৬ টা থেকে এ কর্মবিরতি শুরু হয়। হবিগঞ্জ জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম ফারুক জানান, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী তারা ওই কর্মসূচির সাথে একাত্মতা  পোষণ করেছেন।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে সিরাজগঞ্জ। চালক-শ্রমিকরা বাসসহ গণপরিবহন বন্ধ রাখায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষসহ ব্যবসায়ীরা। ধর্মঘটের কারণে বুধবার সকাল থেকে জেলার অভ্যন্তরীণসহ সকল রুটে বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে সাধারণ মানুষসহ চাকরিজীবী ও ছাত্র-ছাত্রীদের চলাচলে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ধর্মঘটের কারণে সকল পরিবহন বন্ধ থাকলেও রিকশা-সিএনজি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে যাত্রীদের দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বন্ধ থাকায় কাঁচামাল ব্যবসায়ীরাও দুর্ভোগে পড়েছেন। মহাসড়কের কয়েকটি পয়েন্টে শ্রমিকদের বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং জেলার বাইরে থেকে আসা পণ্যবাহী গাড়িগুলোকে চলাচলে বাধা দিতে দেখা গেছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি স্থানে পণ্যবাহী ট্রাক আটকিয়ে তাদের মুখে কালি মেখে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হাজী আনছার আলী জানান, সিরাজগঞ্জ থেকে বিভিন্ন জেলায় যানবাহন চলাচলে নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হচ্ছে। যে কারণে বুধবার সকাল থেকে শ্রমিকরা নিজে থেকেই রাস্তায় যানবহন বের করেনি।

বগুড়া প্রতিনিধি জানান, সড়ক পরিবহন আইন সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন মহাসড়কের ন্যায় বগুড়াতেও পরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বুধবার সকাল থেকে হঠাৎ করে কোনো ঘোষণা ছাড়াই অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় যাত্রীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। কেউবা রিকশা আবার কেউবা অটোরিকশা করে তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। ফলে গুণতে হচ্ছে ২-৩ গুণ বেশি ভাড়া। এদিকে সকাল ১০টার পর থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশাও বন্ধ হয়ে গেছে।

বগুড়া থেকে অভ্যন্তরীণ সব সড়কপথে যাত্রীবাহী বাস ও সারা দেশে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ পণ্যবাহী সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বগুড়া হয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের সব রুটের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।  

ধর্মঘটের কারণে বগুড়া থেকে জয়পুরহাট, রংপুর, নওগাঁ, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ-নগরবাড়ী, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এবং উত্তরবঙ্গ থেকে দণিবঙ্গের সড়কপথে সব ধরনের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। বগুড়া হয়ে ঢাকা-নওগাঁ, ঢাকা-জয়পুরহাট, ঢাকা-রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় দূরপাল্লার বাস চলাচলও বন্ধ রয়েছে। দু’-একটি জেলা থেকে সীমিত কিছু বাস চলাচল করছে। শ্রমিকেরা অটোরিকশা চলাচলেও বাধা দিচ্ছেন।
এদিকে মালিক পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়নি। কারা এর পেছেনে ইন্ধন দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান তারা।

বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান আকন্দ বলেন, আমাদের দেশের কৃষকের পিক টাইম চলছে। রবি শস্য বাজারে তুলবে। সরকারে থাকা কোনো না কোনো অশুভ শক্তি এবং মালিক শ্রমিকের মধ্যে থাকা অশুভ শক্তি এসব কাজে লাগিয়ে প্রান্তিক মানুষের ক্ষতি করার চিন্তা করছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের যদি আন্দোলন সংগ্রামে যেতেই হয় তাহলে আমরা এই সময়টাতে যাবো না কৃষকের দিক বিবেচনা করে। আমরা যা কিছু করবো সময় বুঝে করবো। আমাদের যদি অবরোধ করতেই হয় তাহলে একটা সময় বেঁধে দিয়েই করতে হবে। হঠাৎ করে করার প্রশ্নই ওঠে না। যারা হঠাৎ করে আন্দোলন করছে তারা রাষ্ট্র এবং জনগণের শক্র।

স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল থেকে জানান, গতকাল সকাল থেকে টাঙ্গাইলে পরিবহন শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করেছে। ফলে টাঙ্গাইল শহরের নতুন বাস  টার্মিনাল থেকে ঢাকাসহ সকল সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। তাদের সিএনজি ও ব্যাটারি চালিত অটোতে গন্তব্যে যাতায়াত করতে হচ্ছে।
কালিহাতী উপজেলায় চাকরি করেন আহমদ হোসেন। তিনি জানান, পরিবহন বন্ধ থাকায় সিএনজি ও ব্যাটারি চালিত অটোতে খুব কষ্টে যাতায়াত করতে হয়েছে। এতে ভাড়া দিতে হয়েছে দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। টাঙ্গাইল জেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন সরকার বলেন, বর্তমান আইনের অনেক জায়গায় আমাদের আপত্তি আছে। এই বিষয় নিয়ে আগামী ২১ ও ২২ তারিখে যে মিটিং হবে তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। তার আগেই পরিবহন চালকরা গাড়ি চালাতে অনীহা প্রকাশ করছে। তারা নিজেরাই যানবাহন চালাচ্ছে না।

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে জানান, খুলনার অভ্যন্তরীণ রুটে বুধবার সকাল থেকে বাস চলাচল করার কথা থাকলেও চলছে না। নতুন সড়ক আইন সংশোধন না করার প্রতিবাদে খুলনায় তৃতীয়দিনের মতো অব্যাহত চালকদের কর্মবিরতি। সকালে বাস ছাড়বে এমন খবরে সোনাডাঙ্গা  কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, রয়্যাল ও শিববাড়ীর মোড়ে শত শত যাত্রীরা দূর-দূরান্তে যাত্রার উদ্দেশে এলেও বাস না ছাড়ায় যাত্রা ভঙ্গ হচ্ছে। অধিকাংশ বাস কাউন্ডার বন্ধ রয়েছে। পরিবহন ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার দুপুরে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলো না।

খুলনা সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দু’পক্ষের আলোচনা শেষে মধ্যস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিক  নেতারা চলমান ধর্মঘট প্রত্যাহার করে  নেন।

বৈঠকের পরে খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির  হোসেন বলেন, নতুন সড়ক আইনের কিছু ধারায় মালিক ও চালকদের কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এ কারণে চালক ও মালিকরা ভয়ে গাড়ি বের করছেন না। তবে বৈঠকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগামী কয়েকদিন নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়নে কিছুটা শিথিল করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। তাই ইউনিয়নের পক্ষ থেকে চালক ও মালিকদের গাড়ি চালানোর অনুরোধ করা হচ্ছে। যেহেতু সিদ্ধান্ত নিতে নিতে দুপুর হয়ে গেছে তাই মঙ্গলবার আর নয়, বুধবার  থেকে চালকরা গাড়ি চালাবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, খুলনায় গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সমস্যা হলো অন্যান্য জেলার শ্রমিকদের নিয়ে। খুলনা  থেকে অন্যান্য রুটে বাস গেলেই  সেখানকার শ্রমিকরা তা আটকে দেয়। তারপরও বুধবার থেকে অন্তত অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে  জেলা প্রশাসনের বৈঠকে বাস ছাড়ার সিদ্ধান্তের পরও কেন বাস চলছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে বুধবার সকালে খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম বেবী বলেন, চালকরা কেউ গাড়ি চালাতে চাচ্ছে না। ভোর সাড়ে ৬টায়  সোনাডাঙ্গা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে এসে চালকদের গাড়ি চালাতে অনুরোধ করলেও তারা রাজি হচ্ছেন না। চালকরা বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটলে সব জরিমানা আপনি দেবেন এমন লিখিত দিলে আমরা গাড়ি চালাবো।

এদিকে খুলনা শহর থেকে দূরপাল্লার  কোনো বাস না ছাড়লেও রূপসা-মংলা, রূপসা-বাগেরহাটসহ বেশ কিছু রুটে বাস চলাচল করছে। তাবে যেসব রুটে বাস চলছে না সেই রুটের যাত্রীরা পড়েছেন দুর্ভোগে।
তবে, ধর্মঘটের কারণে সড়ক পথে চলাচল বন্ধ থাকায় ট্রেনে উপচেপড়া ভিড়  দেখা  গেছে। খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে টিকিটের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন অনেকে। সিট না পেয়ে অনেকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।
এই সুযোগে ইঞ্জিনচালিত স্থানীয় যানবাহন মাহেন্দ্র, মিনি পিকআপ, মাইক্রোবাসসহ  ছোট গাড়িগুলো কয়েকগুণ ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব যানে ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা গন্তব্যে যাচ্ছেন।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, সড়ক পরিবহন আইনের সংস্কারের দাবিতে ফরিদপুর থেকে দূরপাল্লার পরিবহনগুলো বন্ধ রেখেছে শ্রমিকরা। সকাল থেকে বিভিন্ন রুটের যাত্রীবাহী বাস বন্ধ রয়েছে। এদিকে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর নেতারা শ্রমিকদের দাবির সাথে একমত না হলেও শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পরিবহন চালাবে না বলে জানিয়েছে। সকাল থেকে ফরিদপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া কুষ্টিয়া, বরিশাল, যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ রুটের সকল ধরনের পরিবহন ছাড়াও ঢাকার দিকে ছেড়ে যাওয়া দুই/একটি পরিবহন ছাড়া সব ধরনের পরিবহন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া জেলার ট্রাক স্ট্যান্ডের থেকে ছেড়ে যাওয়া দূরপাল্লার পণ্যবাহী ট্রাক বন্ধ থাকতে দেখা গেছে।

স্টাফ রিপোর্টার, দিনাজপুর থেকে জানান, দেশব্যাপী ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের ডাকা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে উত্তরের সীমান্ত জেলা দিনাজপুরে। দিনাজপুর থেকে ছেড়ে যাচ্ছে না কোনো পণ্যবাহী ট্রাক কিংবা কাভার্ডভ্যান। জেলার বাইরে থেকে কোনো ট্রাক কিংবা কাভার্ডভ্যান দিনাজপুরেও প্রবেশ করছে না।
তবে, হিলি স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রয়েছে। করা পণ্য  খালাস ও ওঠা নামাও চলছে। এখনও স্বাভাবিক রয়েছে হিলিবন্দর পরিস্থিতি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status