মন ভালো করা খবর

এভাবেও হতে পারে দেশপ্রেম

কাজল ঘোষ

১৮ নভেম্বর ২০১৯, সোমবার, ১০:০৬ পূর্বাহ্ন

আর শহরে নয়। যেতে হবে গ্রামে। মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে হবে। এক অন্যরকম আরম্ভের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। রাজধানীর চাকচিক্য তাকে কাছে টানেনি। নিয়ন আর সোডিয়ামের আলো ছুঁতে পারেনি। ব্যতিক্রম এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তিনি। একজন আব্দুস সাত্তার খান শুদ্ধ মানুষগড়ার চিন্তা মাথায় নেন। যার দেশপ্রেম শুধু কথায় নয়, কাজেও প্রমাণ করবে। সাত্তার অনেকটা নতুন ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করলেন। পুরনো কাজ কিন্তু একেবারেই নতুনভাবে। তা হচ্ছে গ্রামে গ্রামে পাঠাগার তৈরি করা। যা আমরা পাঠাগার আন্দোলন নামে জানি। তবে একটু পার্থক্য আছে তার আন্দোলনে। চার দেয়ালের বাইরেও এ পাঠাগার কাজ করবে। এ পাঠাগারের জন্য অনেক বিস্তৃত পরিসরে ভাবার দরকার নেই। প্রয়োজন শুধু কিছু ভালো মানুষের সংঘবদ্ধ ইচ্ছা। যারা এই ইচ্ছা পোষণ করবেন তাদের বাড়ি থেকে একটি দুটি করে বই এনেই গড়ে তোলা হবে এই পাঠাগার। তা হতে পারে নিজ ঘরেও। ঠিক এভাবেই ১৩ বছর আগে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের অর্জুনা গ্রামে নিজ শোবার ঘরে একটি সেলফে সূচনা করেছিলেন পাঠাগার আন্দোলনের। তখন সব মিলে এই আন্দোলনে সারথি হয়েছিল সাতজন। আজ তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অর্ধশতাধিক গ্রামে।
এর নেপথ্যে কি? এমন প্রশ্নে আবদুস সাত্তার বলেন, সমষ্টির মুক্তির মধ্য দিয়েই ব্যক্তির মুক্তি আসবে। এটাই গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের দর্শন। যদি দশজনের মঙ্গল হয় তাতে ব্যক্তি নিজেও লাভবান হবে। গ্রাম পাঠাগারের মূল উদ্দেশ্য কোনো দেয়ালে বন্দি থাকা নয়। ব্যক্তিই পাঠাগার। একটি শিশু যখন বড় হচ্ছে তখন থেকেই সে যেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। নিজেকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে একটি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে। প্রচলিত পাঠাগারে থরে থরে বই সাজানো থাকবে, সেখানে এসে মানুষ বই পড়বে। আমরা ঠিক এ ধারণার মধ্যে আবদ্ধ নই। এটা দেয়ালহীন পাঠাগার। একজন ব্যক্তিই একটি পাঠাগার হতে পারে এবং তার গ্রামের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তার শুভবোধগুলো ছড়িয়ে দিতে পারে সকলের মধ্যে। তার সমাজের মধ্যে থাকা সমস্যাগুলো নিজেই চিহ্নিত করবে এবং নিজস্ব শ্রম ও অর্থায়নের মাধ্যমে তা নিরসন করবে।

সাত্তার বলেন, গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন কাউকে বই দিয়ে সহযোগিতা করে না, সকলকে পাঠাগার তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা প্রথমদিকে কিছু বই দিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু দেখেছি যদি কোনো এলাকার লোকজন নিজেরা মনে করে না তাদের পাঠাগার দরকার, তা না হলে তা খুব একটা কাজে আসে না। যদি সমমনা লোকজন মনে করে পাঠাগার দরকার তাহলে আমরা পাঠাগার তৈরিতে পরামর্শ দেই। যারা চান পাঠাগার হোক তাদের বলি আপনাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই বই আছে একটি দু’টি করে। তা দিয়েই গড়ে তোলা হবে পাঠাগার।

গ্রাম
 
পাঠাগার আন্দোলনের ঘোষণা
গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন কোনো ক্রমেই পাঠক তৈরির আন্দোলন নয়। যদি পাঠক তৈরি হয়ই সেটি তার বাড়তি পাওনা। এর আসল কাজ হলো প্রথমে গ্রামের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। তারপর সকলকে নিয়ে স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে সবচেয়ে সস্তায়, সহজ বিকল্প উপায়ে অতিদ্রুত তার সমাধান করা।  কোনোভাবেই সরকার বা অন্য কোনো সংগঠনের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। যেমন দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের কারণে মাঝে মাঝে বাঁধ ভেঙে নোনা পানি আবাদি জমিতে ঢুকে পড়ে। এতে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। যদি দ্রুত বাঁধ মেরামত করা না হয় তবে প্রতিদিন জোয়ারের পানি প্রবেশ করে এবং জমির লবণাক্ততা বাড়িয়ে  দেয়। ফলে জমির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়। কিন্তু এ সময়ই যদি একদল উদ্যোগী মানুষ একত্রিত হয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে বাঁধ  মেরামতের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে তা অতি সহজে স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প শ্রমেই দ্রুত মেরামত করা সম্ভব। যা আমরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন দৈনিকে সচিত্র প্রতিবেদন আকারে দেখতে পাই। এখন আমরা ঐ স্বল্প অথচ সংঘবদ্ধ মানুষগুলোর নিরন্তর প্রচেষ্টাকেই আমরা নাম দিতে চাই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’। কারণ ঐ মানুষগুলোর কাছে পুরো গ্রামটাই একটা পাঠাগার। গ্রামের মানুষগুলো হলো বই। আর কলম হলো গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ।
গ্রাম পাঠাগার আজ কোথায় দাঁড়িয়ে
২০০৬ সালে শুরু। সাতজন সারথি মিলে সিদ্ধান্ত কিছু একটা করার। এরপরের বছর ২০০৭ সালে সিডর আঘাত হানে বিস্তীর্ণ দক্ষিণ অঞ্চলে। পাঠাগারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই। সদস্যরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে টাকা ও চাল ওঠাই। কিন্তু বিপদ হয় এগুলো আমরা পাঠাবো কিভাবে? পরে সরকারের ত্রাণ তহবিলে জমা দেয়া হয়। কিন্তু মনে সন্দেহ জাগে এগুলো যথাসময়ে যথাযথ লোকের কাছে  পৌঁছবে কিনা?
তখন মাথায় আসে-যদি ঐ এলাকায় গ্রাম পাঠাগারের মতো একটি সংগঠন থাকতো আর তাদের সঙ্গে যদি আমাদের যোগাযোগ থাকতো তাহলে এই সামান্য কটা জিনিসই এই বিপদের দিনে কত না কাজে আসতো। এই ভাবনা ঢাকার র‌্যামন পাবলিকেশনের রাজন ভাইকে জানালে তিনি আশ্বাস দেন। বলেন, যত বই লাগবে নিয়ে যাবেন, লজ্জা করবেন না। পরে আমরা লেগে যাই নানা জায়গায় পাঠাগার দেয়ার কাজে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নাটোর, বদলগাছি, মধুপুর, সখীপুর, ভূঞাপুরসহ নানা জায়গায় আমাদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে থাকে পাঠাগার। বিছিন্নভাবে যে পাঠাগারগুলো গড়ে উঠছে আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকি। খাগড়াছড়ির অরং পাঠাগার এ রকম একটি পাঠাগার। আমরা যুথবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি নাম নেই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’।

পাঠাগারগুলো গড়ে উঠে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে। এলাকার প্রয়োজন, চাহিদা,  ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে স্থানীয়রাই সিদ্ধান্ত নেন কী হবে তাদের কর্ম পরিকল্পনা। কেমন হবে তাদের কার্যপদ্ধতি। যেমন জেলা ও থানা পর্যায়ে সাধারণ পাঠাগার থাকায় সেখানে পাঠাগারগুলো হয় বিশেষ ধরনের পাঠাগার। এরকমই একটি পাঠাগার হলো লাইসিয়াম গণিত ও বিজ্ঞান সংঘ।  যেখানে আয়োজন করা হয় বিজ্ঞানের নানা সেমিনার, কর্মশালা, ম্যাথ অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞানমেলা এ মনই নানা ধরনের আয়োজন।
নিজের কথায় আবদুস সাত্তার
টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের অর্জুনায় যমুনার পাড়ে জন্ম, ১৯৮১ সালে। ’৯০ সালের পর বিদ্যুৎ আসে গ্রামে। যমুনার ভাঙন দেখেছি। খেলার নেশা ছিল। বাগান করার নেশা ছিল। পরিবারের সবার ছোট ছিলাম। তিন ভাই ও এক বোন। প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে পরে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করি। ঢাকায় শিক্ষকতা দিয়ে পেশা শুরু। পাঠাগার আন্দোলন শুরু কলেজে পড়া অবস্থাতেই।

শহরে চাকরি করলেও মন পড়ে থাকে গ্রামে। কিছু করতে হবে। গ্রামে যেতে হবে, একটি মডেল তৈরি করতে হবে। একটা কিছু করে মানুষকে বলতে হবে আপনারাও আসুন। এ চিন্তা থেকেই গ্রামে ফিরি। সেখানে প্রথমে একটি পাঠাগার আর পরে একটি কলেজ স্থাপন করি সকলের সহযোগিতায়।

কলেজ নির্মাণের সূচনা যেভাবে
স্বপ্ন ছিলই। আর তা আলোর মুখ দেখতে কাজে লাগে একটি ধাক্কা। তা শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। সে সময় হেফাজতও মাঠে নামে। রাজপথে প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে তারা নানা ফতোয়া নিয়ে হাজির হয়। সব পরিস্থিতি দেখে মনে হয় নিজ এলাকায় একটি কলেজের কাজ শুরু করতে হবে। যা সত্যিকার শিক্ষা বিতরণে কাজ করবে। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়বে। সময়টি ২০১৩ সাল। এভাবেই বাস্তবায়ন হয় আরও একটি স্বপ্নের। অর্জুনার সম্ভ্রান্ত বাড়ি “হাজীবাড়ি” কলেজের জন্য ৭০ ডিসিমেল জমি দান করেন। কলেজের নাম রাখা হয় ঐ বাড়ির বিখ্যাত সন্তান হাজী ইসমাইল খাঁর নামে। কিন্তু জায়গা তো হলো- ভবন নির্মাণ, শিক্ষকের বেতন এসবের টাকা আসবে কোত্থেকে।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৫ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০, ৫০০ টাকা এভাবে সকলের দানে ৪৫০০ টাকা উঠে। এই টাকা দিয়ে জমিদাতার নামে একটা সাইনবোর্ড তৈরি হয়। টার্গেট বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তির শতবছর পূর্তির দিনে কলেজ প্রতিষ্ঠা। ঠিক হয় ২২শে ডিসেম্বর হবে কলেজের উদ্বোধন। কারণ ১৯০১ সালের এই দিনেই মাত্র ৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু শান্তিনিকেতনের পথচলা।
এই নিয়ে আমরা গ্রামে কয়েকটা মিটিংও করি। আশা পাচ্ছিলাম না। সিদ্ধান্ত নেই ঋণ করে হলেও কলেজ করার। অনেকের কাছে ঋণ চাই। কেউ পাত্তা  দেয় না। ঢাকার এক বড় ভাই ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেয়ার কথা বলেও হঠাৎ অক্ষমতার কথা জানান। এগিয়ে আসে পড়শি ফাউন্ডেশন। সেখান  থেকে বিনা সুদে ৪০ হাজার টাকা মিলে। ফেসবুকে খবরটি দেখে দেশে ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের সদস্যরা প্রত্যেকে একটা করে খুঁটি দেন। গ্রামের যুবকেরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাটেন মাটি। এভাবেই স্বপ্নের কলেজ বাস্তবে রূপ পায়।

ভবিষ্যতের লক্ষ্য
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সকল উপজেলার কোনো না কোনো গ্রামে একটি করে পাঠাগার গড়া আর ২০২৬ সাল নাগাদ প্রতিটি ইউনিয়নে অন্তত একটি গ্রামে পাঠাগার গড়া। এছাড়াও ২০২১ সালে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তীতে প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে একটি বই মেলার আয়োজন করবে গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন। এছাড়াও বছরজুড়েই আয়োজন থাকছে গ্রাম চেনার। যেখানে নাগরিক জীবন থেকে অনেকটা দূরে ভুলে যাওয়া শৈশবকে খুঁজে যাওয়া যাবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status