বাংলারজমিন

সিলেট-আখাউড়া রেলপথ

লক্কড়ঝক্কর লাইন ট্রেন আর ব্রিজ

ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে

১৮ নভেম্বর ২০১৯, সোমবার, ৮:২২ পূর্বাহ্ন

একটি দুর্ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠার আগেই ঘটছে আরেকটি বড় দুর্ঘটনা। আর এরই সঙ্গে বড় হচ্ছে হতাহতের পরিসংখ্যান। কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে হচ্ছে না স্থায়ী প্রতিকার। কেবল দুর্ঘটনা ঘটলেই হৈচৈ। এরপর যেই আর সেই। ধারাবাহিক একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ঝুঁকিপূর্ণ সিলেট-আখাউড়া রেলপথে এখন ট্রেন চলতে দেখলেই যত দুশ্চিন্তা স্থানীয়দের। আর বাধ্য হয়ে ট্রেনযাত্রী হলেও থাকছে নানা অজানা শঙ্কা। সিলেট-আখাউড়া ১৭৮ কিলোমিটার রেলপথ যেন মৃত্যু ফাঁদ। এখন এমনটিই বলছেন এই রেলপথের উপকারভোগীরা। কারণ এ রেলপথের চরম ঝুঁকিপূর্ণ অধিকাংশ ব্রিজ, লাইন, ইঞ্জিন, বগি, সিগন্যাল, স্লিপার, ফিসপ্লেট, নাট-বল্টু, পাথর, জয়েন্ট পয়েন্ট, ক্রসিং পয়েন্ট, হুক, ক্লিপ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ও রেল স্টেশনসহ সবকিছুই পুরাতন ও জরাজীর্ণ। যথারীতি এখনো ত্যানা (পুরাতন কাপড়), সুতলি, প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে আটকানো হয়েছে ফিসপ্লেট ও নাট-বল্টু। অধিকাংশ স্থানে স্লিপারের সঙ্গে রেল লাইন আটকানোর হুক ও ক্লিপ নেই। জয়েন্ট পয়েন্ট ও ক্রসিং পয়েন্টের ফিসপ্লেট ও নাট-বল্টু থ্রেটহীন অকার্যকর। নেই স্লিপার ও পর্যাপ্ত পাথর। শুধু মৌলভীবাজার জেলা অংশে মনু, পলকী ও বরমচাল ব্রিজসহ ছোট বড় মিলিয়ে রয়েছে ১৫-২০টি চরম ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমত এসব ব্রিজে যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা। চরম ঝুঁকিপূর্ণ এসব রেল লাইন ও ব্রিজ মেরামত না হওয়ায় চোখে দেখা এমন দৃশ্যে এখন ট্রেন চলাচলে এ অঞ্চলের যাত্রীদের কিছুতেই ভয় কাটছে না। নিরাপদ যাতায়াতের মাধ্যমটি এখন অনেকটাই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। আর দুর্ঘটনার শঙ্কায় দিন দিন আস্থাহীন হচ্ছেন যাত্রীরা। কখন যেকোনো জায়গায় ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। লক্কড়ঝক্কর রেললাইন, ট্রেন আর ব্রিজ। জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকম চলছে। এমন মন্তব্য এ অঞ্চলের ট্রেন যাত্রীদের। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শুধু ঠিকঠাক আছে রেলপথ। আর সবকিছুই নড়েবড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর হতাহতের পর নতুন করে আবারো ভয় জেগেছে এ অঞ্চলের যাত্রীদের। স্বাচ্ছন্দ্য আর নিরাপদ যাতায়াতে ভরসার রেলপথ হয়ে উঠেছে আতঙ্কের কারণ। জানা যায় ১২ই নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার আগে এ পথে ঘটেছিল এ রকম আরেকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ২৩শে জুন রাতে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ‘উপবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি রাত সাড়ে ১১টার দিকে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকার বড়ছড়া ব্রিজে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এ সময় রেলপথের একটি ব্রিজ ভেঙে ২টি বগি ব্রিজের নিচে ও অন্য ৩টি বগি খাদের পাশে পড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত ও প্রায় ৩ শতাধিক যাত্রী আহত হন। এ দুর্ঘটনায় গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটির তদন্ত রিপোর্টগুলোতে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ত্রুটিবিচ্যুতিসহ ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে নানা সুপারিশও করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- মূলত দুর্ঘটনাস্থলের রেলপথ যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়াও ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে যেসব জায়গায় রক্ষণাবেক্ষণ ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে দ্রুত সেগুলো মেরামত করা। ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ম্যানুয়েলের নির্দেশনা নিয়মিত এবং যথাযথভাবে সম্পাদন করা। আখাউড়া-সিলেট সেকশনে কর্মকর্তা পর্যায়ে নিয়মিত ট্রলি নিয়ে পরিদর্শন করে ত্রুটি শনাক্ত করা। মেরামত করাসহ ৭ দফা সুপারিশও করেন তারা। বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এমন স্থান, সেতু, রেললাইন শনাক্ত করে ত্রুটিমুক্ত করা এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ। ট্র্যাক ও কোচ রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পদগুলোর শূন্যপদে জরুরি জনবল নিয়োগ এবং ট্র্যাক ও কোচ রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বাড়াতে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে জানালেন এ রেলপথের যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম রোডে প্রতিদিন চলাচল করে পারাবত, উদয়ন, পাহাড়িকা, জয়ন্তিকা, উপবন, কুশিয়ারা, কালনী, ডেমু ও জালালাবাদ ট্রেন। সিলেট অঞ্চলে রেল যোগাযোগ চালু হয় বৃটিশ আমলেই। ওই সময়ে রেলের নির্মিত লাইন, ব্রিজ ও স্টেশন দিয়েই এখনো চলছে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় রেলপথ। কিন্তু এ রেলপথে বড় আকারের সংস্কার হয়েছে খুবই কম। জানা যায় প্রায় ৯ মাসে রেলের সিলেট রেলপথে ছোট-বড় প্রায় ২০টিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২০ জন যাত্রী। আর আহত হয়েছেন প্রায় ৪ শতাধিক। এ সময়ে দেশের অন্য কোনো রেলপথে এত দুর্ঘটনা ঘটেনি। জানা যায়, চলতি বছরের ৯ই মার্চ ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় জয়ন্তিকা ট্রেন। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের কুশিয়ারা রেল সেতুর দক্ষিণে রেল লাইনের এক ফুট ভেঙে যায়। স্থানীয় এক ব্যক্তি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি মাইজগাঁও রেলস্টেশনে জানান। পরে ওই রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই সময় জয়ন্তিকা ট্রেনও যাত্রাপথে ছিল। গেল ৫ই এপ্রিল সিলেট-মাইজগাঁও রেল স্টেশনের মধ্যবর্তী মোগলাবাজার এলাকায় কুশিয়ারা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। একইদিন রাতে মাইজগাঁও স্টেশন এলাকায় শাহজালাল সার কারখানা থেকে সার বহনকারী বিসি স্পেশাল ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়। ১৬ই মে কুশিয়ারা সেতু পার হয়ে মল্লিকপুর এলাকায় লাইনচ্যুত হয় একটি ট্রেন। আর ২রা জুন হবিগঞ্জের বাহুবল এলাকায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। ২৩শে জুন রাতে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ে উপবন এক্সপ্রেস। এ দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪ জন, আহত হন প্রায় তিন শতাধিক। ২৮শে জুন সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস বড়ছড়া রেল সেতুর আগে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আটকা পড়ে। ৭ই জুলাই ঢাকা থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা কুলাউড়ার হাজীপুর পলকী ও মনু ব্রিজের মধ্যবর্তী এলাকায় একটি গরুকে ধাক্কা দিলে হুইস পাইপ ভেঙে বিকল হয় ইঞ্জিন। ১৯শে জুলাই সিলেট থেকে ঢাকাগামী জয়ন্তিকা কুলাউড়া জংশন স্টেশনে প্রবেশের সময় বগি লাইনচ্যুত হয়। ২০শে জুলাই একই স্থানে লাইনচ্যুত হয় ঢাকাগামী কালনী। ১৬ই আগস্ট রাতে ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও এলাকায় ঢাকাগামী উপবনের চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ৪ঠা সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে সিলেটগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয় ফেঞ্চুগঞ্জের মল্লিকপুরে। ১৭ই সেপ্টেম্বর একই ট্রেন মাইজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় লাইনচ্যুত হয়। ৪ঠা অক্টোবর চট্টগ্রামগামী জালালাবাদ ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় লাইনচ্যুত হয়। এ ছাড়াও ছোট ছোট দুর্ঘটনায় সিডিউল বির্পযয়সহ যাত্রী বিড়ম্বনার একাধিক ঘটনা রয়েছে। এ অঞ্চলের যাত্রীদের দাবি দুর্ঘটনা রোধে সিলেট-ঢাকা, সিলেট চট্টগ্রাম রোডে দ্রুত মেরামত ও স্থায়ীভাবে নতুন করে নির্মাণকাজের প্রয়োজন। বিশেষ করে সিলেট-আখাউড়া ১৭৮ কিলোমিটার রেলপথ সংস্কার এবং চরম ঝুঁকিতে থাকা ব্রিজ, ট্রেনের মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও জরাজীর্ণ বগি দ্রুত পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তাদের দাবি দ্রুত চরম ঝুঁকিপূর্ণ মৃত্যু ফাঁদের অনিরাপদ এই রেল লাইনটি দুর্ঘটনা রোধে মেরামত ও নির্মাণের।



 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status