প্রথম পাতা

ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে আবরার হত্যা

২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট, সরাসরি অংশ নেয় ১১ জন

স্টাফ রিপোর্টার

১৪ নভেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এই হত্যা মামলার চার্জশিটে বুয়েট ছাত্রলীগের ২৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। হত্যায় সরাসরি ১১ জনের সম্পৃক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। বাকি ১৪ জন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলো। চার্জশিটের সঙ্গে আলামত হিসাবে পাঁচটা ক্রিকেট স্ট্যাম্প, একটি স্কিপিং রোপ, দুটি সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিডি, পাঁচটি মোবাইল ফোন, ম্যাসেজের স্কিনশর্ট এবং একটি ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে। গতকাল দুপুরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান। এর আগে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা জানিয়েছেন, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, একটি ভয়ের রাজত্ব কায়েম করতে দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া হিসাবে উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা আবরারকে হত্যা করেছে। তারা জুনিয়রদের এক ধরণের আতঙ্ক ও ভয়ে রাখতো। জুনিয়ররা তাদেরকে সালাম না দিলে, ছোটখাটো বিষয়ে দ্বিমত করলে, তাদের মতের বিরুদ্ধে গেলে বা তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে ডেকে নিয়ে মারধর করতো। যাতে একজনের নির্যাতন দেখে অন্যরা ভয় পায়। যাদের পছন্দ হত না তাদের এনে নির্যাতন করতো। তারা উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়কে তারা শেল্টার হিসাবে ব্যবহার করতো।

তাদের মধ্যে ছাত্রসুলভ আচরণ ছিল না। কর্তৃত্ববাদী আচরণ করার জন্য তারা রাজনৈতিক ফ্লাটফর্ম ব্যবহার করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি’র প্রধান বলেন, গত ৬ই অক্টোবর রাতে শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদকে তার রুম থেকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। রাত ১০টা থেকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে তাকে মারধর করা হয়। সেখান থেকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে আবার তাকে মারা হয়। রাত ২টা ৫০ মিনিটে চিকিৎসক এসে আবরারকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন আবরারের বাবা ১৯ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনাম কয়েকজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। তিনি বলেন, আবরার হত্যা মামলায় ডিবি তদন্ত করে এখন পর্যন্ত ২৫ জনের জড়িত থাকার প্রমান পেয়েছে। এজাহারভুক্ত ১৯ জন ছাড়া আরও ছয় জন রয়েছে। এজাহারভুক্ত ১৯ আসামির ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর এজাহারের বাইরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও পাঁচ জনকে। এই মামলার অভিযোগপত্রে ৩১জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এরমধ্যে বাদী পক্ষের ছয় জন ছাড়া রয়েছে, সাতজন শিক্ষক, আবরারকে মৃত ঘোষণাকারী চিকিৎসক, শেরেবাংলা হলের ক্যান্টিন বয়, সিকিউরিটি গার্ডসহ মোট পাঁচ জন কর্মচারী এবং ১৩ জন শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিসি টিভির ফুটেজ এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা, আসামিদের মেসেজ আদান প্রদান ও সাক্ষীদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। সিসি টিভির ফুটেজে ১৯ জনের চেহারা স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

মনিরুল ইসলাম বলেন, আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছে ১১ জন। এদের মধ্যে আট জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বাকী তিনজনের মধ্যে মেহেদী হাসান রাসেল এখনও জবানবন্দি দেয়নি। আর মাহমুদুল জিসান ও এহতেশামুল রাব্বি তানিম পলাতক। বাকি ১৪ জন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই হত্যাকান্ডে জড়িত। তাই এই ১৪ জনকেও তথ্যপ্রমানের ভিত্তিতে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে রাত ১০টার পর আবরারকে নির্যাতন করা শুরু হয়। আর রাত আড়াইটার পর একজন চিকিৎসককে ডাকা হয়। দীর্ঘ সময় তাকে মারধর করা হয়েছে অথচ আরও আগে যদি চিকিৎসককে ডাকা হতো তবে আবরারের এমন নৃশংস পরিণতি হতো না।

শিবির সন্দেহে আবরারকে হত্যা করা হয়েছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মনিরুল বলেন, একক কোনো কারণে না। আবরার শিবির করে এটি একটি কারণ মাত্র। অনেকগুলো কারণের সমষ্টিতে তাকে মারধর করা হয়। আসামিরা বলেছে, আবরারের আচরণগত সমস্যা ছিলো। সে ফেসবুকে তির্যক মন্তব্য করত, যেটি তারা মনে করত তাদের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। সে তাদেরকে সালাম দিত না। এছাড়া ঘটনার আগে ফেসবুকে সে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলো।   যেটিকে তারা অন্যভাবে নিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বুয়েট হল প্রশাসনের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব ছোটখাটো বিষয়ে হল প্রশাসনের আরেকটু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। এই বিষয়গুলো তাদেরই মনিটরিং করার কথা। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার বিশ্লেষণ করে আমাদের তদন্তে হল প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টি উঠে এসেছে।

প্রকাশ্যে রড দিয়ে বিশ্বজিতকে পেটনোর পর তাদের শাস্তি কার্যকর হয়নি আরবারের বেলায় এমনটি হবে কি-না জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, বিশ্বজিতকে প্রকাশ্যে যারা পিটিয়েছে তাদের শাস্তি বহাল আছে। যারা সরাসরি জড়িত ছিল না, তাদের কেউ কেউ উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছে। কেউ কেউ উচ্চ আদালতে গিয়ে শাস্তি কমিয়েছে। আবরারের বেলায় এমন হবে আশা করছি না। কারণ ডিএমপি তদন্তে আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়েছে। প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে ঘটনা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে।

অমিত সাহার বিষয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অমিত সাহা ঘটনাস্থলে না থাকলেও ঘটনার আগে এবং ঘটনার দিন হত্যায় পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। ঘটনার আগেও সে আবরারকে শায়েস্তা করতে চেয়েছে।  আগেও আরেক শিক্ষার্থীকে পিটিয়েছে অমিত সাহা। সে কারণে অমিত সাহাকে অভিযোগপত্রে একজন অন্যতম আসামি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আবরার হত্যা মামলায় এজাহারভুক্ত ১৯ আসামিরা হলো: সিই বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, সিই বিভাগের ১৪ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, একই ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের উপ সমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল, এমই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সদস্য মুনতাসির আল জেমি, একই ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা, ই্‌ইই বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সদস্য মুজাহিদুর রহমান, সিই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শামীম বিল্লাহ, এমএমই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাজেদুল ইসলাম, সিই বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আকাশ হোসেন, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, ইইই বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহমুদুল জিসান, সিএসই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোয়াজ আবু হোরায়রা, এমই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এ এস এম নাজমুস সাদাত ও একই বিভাগের শিক্ষার্থী মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম।
এজাহারের বাইরে গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে: বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং মেকানিক্যাল তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইসতিয়াক আহমেদ, বুয়েট ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক উপসম্পাদক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী অমিত সাহা, ওয়াটার রিসোর্সেস বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আরেফিন রাফাত, বুয়েট ছাত্রলীগের উপ দপ্তর সম্পাদক মুজতকা রাফিদ ও কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মাহামুদ সেতু।

এজাহার ও এজাহারের বাইরে পলাতক যারা: সিই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এহতেশামুল রাব্বি তানিম, ইইই বিভাগের ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহমুদুল জিসান, এমই বিভাগের ১৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম এবং কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মুজতবা রাফিদ।

আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে: মেহেদী হাসান রবিন, অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, এ এস এম নাজমুস সাদাত এবং খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর।

আবরারকে মারধরে সরাসরি অংশ নিয়েছে: মেহেদি হাসান রবিন, অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বি তানিম এবং খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status