শেষের পাতা

সংসদে রাঙ্গার কড়া সমালোচনা

সংসদ রিপোর্টার

১৩ নভেম্বর ২০১৯, বুধবার, ৯:১৪ পূর্বাহ্ন

জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও সংসদের বিরোধীদলের চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি তাকে জাতীয় পার্টির মহাসচিবের পদ থেকে বহিষ্কারেরও দাবি জানিয়েছেন এমপিরা। গতকাল সংসদ অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তি ও ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্যের জন্য এ দাবি জানানো হয়। তার বক্তব্য নিয়ে গতকাল উত্তপ্ত হয়ে উঠে সংসদ অধিবশেন। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন সরকারদলীয় এমপিরা। এসময় সংসদে তার বিরোধী দলের চিফ হুইপের পদ নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। তীব্র ক্ষোভ, উত্তেজনা ও অসন্তোষের মধ্যে দলের পক্ষ থেকে মশিউর রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যের জন্য দুঃখ ও ক্ষমা চেয়ে জাতীয় পার্টির দু’জন সিনিয়র সদস্য দাঁড়িয়ে বলেন, এটি জাতীয় পার্টির নয়, মশিউর রহমান রাঙার একান্তই ব্যক্তিগত বক্তব্য। এর দায় জাতীয় পার্টি নেবে না। তবে তাঁর এই লজ্জাজনক বক্তব্যের কারণে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি, ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এক পর্যায়ে সরকারি দলের সিনিয়র নেতাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও মহাসচিব রাঙ্গার কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। এক সময় যুবদল করে আসা মশিউর রহমান রাঙা কীভাবে জাপা মহাসচিব, সাবেক প্রতিমন্ত্রী হলেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।  এ নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক চলার সময় সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙা। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও বিতর্ক চলাকালে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের নিজ আসন থেকে উঠে গিয়ে অধিবেশনে থাকা সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কিছু সময় কথা বলতে দেখা যায়। তবে অধিবেশনে এ নিয়ে কোন কথা বলেননি জি এম কাদের। মাগরিবের নামাজের বিরতির পর পয়েন্ট অব অর্ডারে অনির্ধারিত এ বিতর্কের সূত্রপাত করেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী। এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে কথা বলেন, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক চুন্নু।

তাঁরা সবাই জাপা মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গার কটুক্তিমূলক বক্তব্যের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি তাঁকে সংসদে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান। অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। মশিউর রহমান রাঙা সেই চেষ্টা করেছেন। নুর হোসেন যখন হত্যা হয়, তখন দেশে ফেনসিডিল ইয়াবা ছিল না। ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু’র কথা বলা হয়। এই ভোট ডাকাতি-মিডিয়া ক্যু’র মূল হোতা ছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। আজ সেটাকে ঢাকার জন্য রাঙা এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারেন না। তিনি বলেন, এরশাদের সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নির্যাতন ও পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। এরশাদকে শুধু আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার বলে না, সারাদেশের মানুষ তাকে স্বৈরাচার বলে অভিহিত করেছে। সারাবিশ্বে এরশাদ স্বৈরাচার বলে পরিচিত। তাই জাপা মহাসচিব রাঙাকে অবশ্যই তাঁর কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।

তোফায়েল আহমেদও মশিউর রহমান রাঙাকে জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মশিউর রহমান রাঙা এমন একটি বক্তব্য দিয়েছেন, তা বাংলার মানুষের হৃদয়ে আঘাত লেগেছে। নূর হোসেন হত্যার পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়, দেশের মানুষ রুখে দাঁড়ায়। অথচ রাঙা সাহেব ভুলে গেছেন, এরশাদ সাহেব নুর হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন, সংসদে ক্ষমা চেয়েছিলেন। অথচ রাঙা শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে তু্‌চ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এই বক্তব্যের জন্য তাকে ধিক্কার জানাই। তিনি বলেন, মশিউর রহমান রাঙার এমন বক্তব্যের কারণে সারাদেশে স্বৈরাচার শব্দটি উচ্চারণ হচ্ছে, তার কুশপুত্তলিকা দাহ হচ্ছে। তাই রাঙা যে বক্তব্য দিয়েছে সেজন্য অবশ্যই তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, মশিউর রহমান রাঙা যে কথা বলেছে, এটা কোনো সুস্থ্য মানুষ বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলার আগে তাকে চিন্তা করা দরকার ছিল।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানের স্বার্থে কাজ করেছেন। রাঙার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের উপর আঘাত। মশিউর রহমান রাঙাকে শুধু ক্ষমা চাইলেই হবে না। জাতীয় পার্টিকে তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে হবে। ক্ষমা তো তাকে চাইতেই হবে, তা না হলে গণতন্ত্রের জন্য ক্ষত থেকে যাবে। সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী, শহীদ নুর হোসেনকে নিয়ে কটাক্ষ করে কথা বলেছেন মশিউর রহমান রাঙা। কথায় আছে ’রতনে রতন চেনে....’। আমি বাকি কথাটা আর বললাম না। যে নুর হোসেনকে সামনে রেখে আমরা আন্দোলন করেছি, তাকে তিনি কটাক্ষ করেছেন। এটা করে তিনি সংসদকে অপমান করেছেন। কারণ স্বৈরাচারের পতন না হলে রাঙা সাহেব সংসদে এসে বসতে পারতেন না।

বিতর্কের সূত্রপাত করে তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, শহীদ নুর হোসেনকে নিয়ে অপমানজনক বক্তব্যের প্রতিকার চাই। মশিউর রহমান রাঙা বঙ্গবন্ধুকে কটুক্তি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটুক্তি করেছেন। তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। এ জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।

রাঙ্গাকে নিয়ে জাতীয় পার্টির এমপিদের বক্তব্য
এদিকে নূর হোসেন সম্পর্কে জাতীয় পার্টির মহাসচিবের বক্তব্য নিয়ে সংসদে কড়া সমালোচনা করেন তার দলেরই প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন,বান্দরকে লাই দিলে গাছের মাথায় ওঠে। আমি যতদিন রাজনীতি করি ততদিন ওর বয়সও না। ও এই ধৃষ্ঠতা দেখায় কিভাবে, এই দুঃসাহস কিভাবে পেল? এই সংসদই তাকে লাই দিয়েছে। তার বক্তব্য আমি শুনেছি, আমি সেদিন সভায় ছিলাম না। পরে এটা ভাইরাল হয়ে গেছে। আমি শুনেছি। এই বক্তব্য জাতীয় পার্টির বক্তব্য না। এটা কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য হতে পারে না। এটা রাঙ্গার নিজস্ব বক্তব্য হতে পারে।

এই বক্তব্যের জন্য জাতীয় পার্টি লজ্জিত। আমরা দুঃখিত এবং অপমানিত অনুভব করছি। তিনি বলেন, নূর হোসেন ৯০ তে তার জীবন দিয়ে গেছেন। যে যুবক গণতন্ত্রের জন্য তার জীবন দিতে পারেন, স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করতে পারে সে সাহসী যুবকের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। আমরা কখনো এই ধরণের ধৃষ্টতা দেখাই নাই। এই ধরণের অপমানজনক কথা কখনো বলি নাই। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার বক্তব্য হতে পারে না। তিনি বলেন, তাকে এই লাই সংসদই দিয়েছে। কি ধরণের লোককে এ ধরনের পদে বসায় যাদের অতীত বর্তমান কিছুই ছিল না। হঠাৎ তাকে মন্ত্রী বানানো হলো। একটার পর একটা প্রমোশন দেয়া হল। আমরা তো তাজ্জব হয়ে গেলাম। এগুলো আমরা দেইনি। এই সংসদে বসে চিফ হুইপ হিসেবে। আমি একদিন বললাম, তাজুল ইসলাম চৌধুরী মারা গেছে তার বিষয়ে বক্তব্য রাখব। বলে আপনি দেবেন আমি কেন নাম পাঠাব। এই ধৃষ্ঠতা ও দেখাতে পারে। বঙ্গবন্ধু জাতির জনক।

এই বাঙলি জাতিকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যে দলই করি যেখানেই থাকি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। সেদিন সাড়ে ৭ কোটি লোককে এক করেছিল যে নেতা তার সম্পর্কেও সেদিন কিছু কথা বলেছে। যেগুলো আমি উচ্চারণ করব না। শুধু তাই না প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কথা বলেছেন। সে গণতন্ত্রের ছবক দেয়। যে লেখাপড়া করে নাই। রাতারাতি কাগজের মালা গলায় দিয়ে পরিবহনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে হঠাৎ করে এখানে এসে বাড়ি গাড়ীর মালিক হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করেছি। আমাকে যদি প্রধানমন্ত্রী সেদিন পরিচয় করে না দিতেন আমার জন্য যদি ভোট না চাইতেন আমি নির্বাচিত হয়ে এই সংসদে আসতে পারতাম না। মানুষ এত অকৃতজ্ঞ হয় কিভাবে? রাঙ্গা সাহেব মনে করছেন ওনার নিজের জোরে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। উনার পিছে যদি আওয়ামী লীগ না থাকত ওই রংপুরে নামতেও পারত না। কার কত ভোট আছে আমাদের জানা আছে। জাতীয় পার্টির অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, মশিউর রহমান রাঙার বক্তব্যে জাতীয় পার্টি দলীয়ভাবে সমর্থন করে না। এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status