প্রথম পাতা

প্রশাসনের আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান,কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা

উত্তাল জাবি দিনভর বিক্ষোভ

পিয়াস সরকার, জাবি থেকে

৭ নভেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৭ পূর্বাহ্ন

শিক্ষার্থীদের আগলে শিক্ষকদের অবস্থান ম ছবি: জীবন আহমেদ

সকাল থেকেই ছিল থমথমে পরিস্থিতি। ভিসি ফারজানা ইসলামের পদত্যাগের দাবিতে চলা আন্দোলনের অংশ হিসেবে দিনভর বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন দমাতে হল ত্যাগের দফায় দফায় নির্দেশ দেয়া হলেও শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে ক্যাস্পাসে অবস্থান করেন। মঙ্গলবার রাতে হলের তালা ভেঙে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ছাত্রীরা। গতকাল প্রশাসনের পক্ষ থেকে হলগুলোতে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। আন্দোলনরতদের অবস্থানে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও হলে এবং আশপাশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অবস্থান করতে দেখা গেছে। দিনভর বিক্ষোভের পর বিকালে আন্দোলনরতরা ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। রাত নয়টা পর্যন্ত অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার পর দিনের কর্মসূচি শেষ করা হয়। আজ থেকে আবার বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে চলা আন্দোলনের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিলেন আন্দোলনরতরা। সেখানে ভিসিপন্থি শিক্ষক কর্মচারিদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতি থেকে চার শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। হামলার প্রতিবাদে কর্মসূচি পালিত হয়েছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

গতকাল সকাল ১০ টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করের শিক্ষার্থীরা। এসময় অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলো প্রীতিলতা ও খালেদা জিয়া হলের শিক্ষার্থীরা। এরপর ছাত্রীদের দাবির মুখে গেট খুলে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। এরপর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। এসময় শিক্ষার্থীরা আওয়ার ক্যাম্পাস আওয়ার রাইট, হল ভ্যাকান্ট এর ঘোষণা মানিনা মানবোনা, দুর্নীতিবাজের ঘোষণা মানিনা মানবোনা এমন স্লোগান দেন। সকালে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকলে সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেন প্রশাসনের লোকজন। পরে ডাক দেয়া হয় সংহতি সমাবেশের। সমাবেশে যোগ দেন শিক্ষক, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও আন্দোলনরতরা।

সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক তানজিম হোসেন, জাবি অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায়, ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্সসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এটি হল বন্ধ করে নিরসন হবে না। গতকাল যে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের উপর হামলা হয় এটি করা হয় ছাত্রলীগের মাধ্যমে। এমন একটি সংগঠনের মাধ্যমে হামলা করা হয় যে সংগঠন প্রকাশ্যে বিশ্বজিতকে হত্যা করে। আমি ভিসি মহোদয়ের কাছে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ শিক্ষা ও গবেষণা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনরতদের দাবি মেনে নিন। জাহাঙ্গীরনগরের ঐতিহ্য আন্দোলনের ঐতিহ্য। এই আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যাবে না। গতকাল ছাত্রীরা তালা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। এই আন্দোলনকে কোনভাবেই আপনি দমাতে পারবেন না।

মঙ্গলবারের হামলায় আহত শিক্ষার্থী রাকিবুল ইসলাম রনি স্থানীয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি সেখান থেকে সমাবেশে যোগ দিয়ে বলেন, আজ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের উপর হামলা করলেন, একবারও ভাবেননি আমি আপনাকে অভিভাবক ভাবি। আমি আপনার সন্তান। দুপুরে কিছু সময় বিরতির পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিকাল ৫ টার দিকে মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে আসলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। এসময় পুলিশের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষায় হাতে হাত রেখে ভিসির বাসভবনের সামনে সড়কে বসে পড়েন আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষকরা। এসময় শিক্ষার্থীরা মঙ্গলবার রাতে তাদের ওপর হামলার বর্ণনা দেন।

হামলার শিকার শিক্ষার্থী বলেন, আমি আহত হয়েছি তাতে কিছু হবে না। আমার মতো অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা সত্যের পক্ষে লড়তে প্রস্তুত আছেন। আপনারা অবস্থান চালিয়ে যান ন্যায়ের এই আন্দোলন চলবে যতোদিন না দাবি আদায় হবে। ভিসির বাসভবনের সামনে তারা স্লোগানসহ বিভিন্ন দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাদের সঙ্গে ছিল ঢোল ও মন্দিরা। এদিকে দফায় দফায় হল ছাড়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও গতকাল সকাল পর্যন্ত হলেই ছিলেন আন্দোলনরতরা। তারা হল থেকে আন্দোলনে অংশ নেয়ায় প্রশাসন দুপুরে ঘোষণা দেয় বিকাল সাড়ে তিনটার মধ্যে হল না ছাড়লে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে পুলিশ তল্লাশি চালাবে। প্রশাসনের এ নির্দেশনা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। যদিও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে আগের দিনই হল ছেড়ে চলে যান। গতকল বিকালে হলে হলে তালা লাগিয়ে দেয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বন্ধ করে দেয়া হয় পানি বিদ্যুৎসহ সব সেবা। হল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাসের সব খাবার দোকানও বন্ধ রাখা হয়। দিনভর অবস্থান থাকায় বিকালে দুই দফা সময় পরিবর্তন করেন। রাত সাড়ে নয়টর মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশনা দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

এদিকে, সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি আবাসিক হলের অনেক শিক্ষার্থীকে হল ছাড়তে দেখা যায়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হল না ছাড়ায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরও হলে অবস্থান করতে দেখা যায়। এ কারনে হামলার আশঙ্কা ছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝে। আরিফ হোসেন ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, বাড়িতে যেতে বললেই যাওয়া যায় না। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে জানি। কথা বলতে জানি আমার ভাইয়ের ওপর, বোনের ওপর, শিক্ষকের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাতে। ভাসানী হলের এক ছাত্রলীগ নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশের পরও হলে অবস্থান কেন করছেন জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনিয়মের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণসহ অভিযোগ পেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় ছাত্রলীগের কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার বিকালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনন্সিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে নওফেল বলেন, কেউ যদি মনে করে কোনো পক্ষ দোষ করেছে, কোনো অনিয়ম হয়েছে, সেই দোষ বা অনিয়মের প্রমাণাদিসহ আপনারা আমাদের কাছে আসুন। আমরা ইতোমধ্যেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছি লিখিত অভিযোগ দিলে অবশ্যই আমরা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেব। কিন্তু সেই ধরনের অভিযোগ আনার আগেই যদি আমরা এমন অচলাবস্থার তৈরি করে ফেলি যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং এই মুহূর্তে আমাদের তদন্ত করতে বেগ পাওয়ার কথা নয়। যারা শিক্ষকমন্ডলী আছেন, তারা তো এই মুহূর্তে শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত নেই। আন্দোলনকালীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ছাত্রলীগ নামধারী বা পদবিধারী কোনো নেতা-কর্মী যদি সেখানে থেকে থাকে তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। জাহাঙ্গীরনগরের সব পক্ষকে ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, সকলের কাছে আমরা আহ্বান জানাব যে, এই আন্দোলন বা অচলাবস্থা যাই বলি না কেন, এর ফলে আমাদের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আজকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে এবং সেখানে যে উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে সেটাও স্থবির হয়ে পড়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status