শেষের পাতা

‘হেমার’ দিয়ে হাত-পা ভাঙা হলো সালামের

জাফলংয়ে নির্মমতা

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

২৪ অক্টোবর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:১৫ পূর্বাহ্ন

জাফলংয়ের নয়াবস্তির আঠারো বছর বয়সী তরুণ সালাম মিয়াকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে সন্ত্রাসীরা। লোহার রড, চাপাতি ও হেমার দিয়ে পিটিয়ে হাত ও পা ভেঙে দেয় তারা। এরপর আহত সালামের বিরুদ্ধেই থানায় মামলা করে। আসামি সালামকে গতকাল কোলে করে তোলা হয় আদালতে। তার শারীরিক অবস্থা দেখে আইনজীবীরা হতবাক। তারা সালামের ওপর চলা নির্মমতার বিবরণ জানান আদালতকে। এরপর আদালত শুধু সালামকেই নয়, মামলার সকল আসামিকে জামিন দিয়েছেন। জামিন শেষে ফের কোলে করে সালামকে তুলে আনা হয় গাড়িতে। আদালত থেকে বেরিয়ে ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন সালাম। তাকে বিকালে ভর্তি করা হয়েছে নগরীর ইবনে সিনা হাসপাতালে। জামিনের পর মানবজমিনের কাছে সালাম জানান নির্মমতার কথা। ১৭ই অক্টোবর তিনি জাফলং নদীতে মাছ ধরতে জাল পাতেন। সকালে জাল পাতার পর তিনি বিকাল ৩টার দিকে জাল তুলতে যান। দেখেন তার জাল নেই। লিস্টার মেশিন দিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে একই গ্রামের সন্ত্রাসী ও পাথরখেকো সিন্ডিকেটের প্রধান আলিম উদ্দিন ও তার লোকজন। এতে তিনি প্রতিবাদ করেন। আর এই প্রতিবাদ করার পরপরই আলিম উদ্দিন ও তার লোকজন হাতে থাকা লোহার রড, চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করে। এ সময় তিনি মারধর না করতে তাদের অনুনয় বিনয় করেন। এতেও মন গলেনি আলিম উদ্দিন সহ তার সহযোগীদের। তারা দলবেঁধে পেটায়। এতে রক্তাক্ত হয়ে পড়েন তিনি। শরীরে জোর পাচ্ছিলেন না। চিৎকারের ভাষাও হারিয়ে ফেলেন। দলবেঁধে পেটানোর দৃশ্যটি দূর থেকে দেখেন সালামের মামা ভেলু মিয়া। তিনি দৌড়ে এসে সালামকে জাপটে ধরেন। এ সময় ভেলু মিয়াকেও নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। খবর পেয়ে বাড়ি থেকে দৌড়ে যান সালামের ভাইয়েরা। এ সময় হামলাকারীরা চলে যায়। গুরুতর অবস্থায় সালাম ও ভেলু মিয়াকে উদ্ধার করে হাসপাতালে রওনা দেন তার ভাইয়েরা। পথেই ছিল আলিম উদ্দিন সহ হামলাকারীদের বাড়ি। বাড়ির সামনে আসামাত্র আলিম উদ্দিন সহ ওই সন্ত্রাসীরা সালামকে বহনকারী গাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় আলিম উদ্দিন, তার ভাই শাহজাহান, রেজওয়ান, রায়হান সহ কয়েকজন তাদের গাড়ি থেকে টেনে নামায়। হাতে থাকা হেমার দিয়ে সালামের পা ও হাতে আঘাত করে। এতে করে সালামের পা, পায়ের তিনটি আঙ্গুল, বাম হাত ও বাম হাতের তিনটি আঙ্গুল ভেঙে গেছে। খবর পেয়ে গোয়াইনঘাট থানার এসআই রাজিব স্থানীয় মেম্বার আতাই গিয়ে তাদের উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

সালাম জানান, পুলিশ ও স্থানীয় মেম্বার গিয়ে না উদ্ধার করলে ওরা আমাকে মেরেই ফেলতো। এমন নির্মমতার পর সালাম মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। রাতে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠেন বলে জানান সালামের ভাই আলমাছ মিয়া। তিনি মানবজমিনকে জানান, দ্বিতীয় দফা হামলায় তিনি, তার পিতা আব্দুশ শহীদ ও ব্যবসায়ীক পার্টনার লিটু আহত হন। এদিকে ঘটনার পরপরই পুলিশ অভিযান চালিয়ে হামলাকারী সন্ত্রাসী আহাদ ও জাকিরকে আটক করেছে। রাতে এ ঘটনায় সালামের মামা কুঠিন মিয়া বাদী হয়ে গোয়াইনঘাট থানায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কিন্তু মামলা করেও তারা স্বস্তিতে নেই। সালামের ভাই খোকন মিয়া মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তিনি গোয়াইনঘাট সার্কেলের এএসপি নজরুল ইসলামকে ফোন দিয়েছিলেন। এ সময় তিনি আলিম উদ্দিনের কথা জানালে এএসপি নজরুল ক্ষেপে যান। এবং আলিম উদ্দিনকে আসামি না করতে নির্দেশ দেন। খোকন জানান, এএসপি নজরুল ও গোয়াইনঘাটের ওসি তদন্ত হিল্লোর রায় মামলা দায়ের নিয়ে নানা নাটকীয়তা করেন। তারা মামলা থেকে পাথরখেকো চক্রের প্রধান আলিম উদ্দিনের নাম বাদ দিতে টালবাহানা করেন। তবে ওসি আব্দুল আহাদ ঘটনার নির্মমতা বুঝে আমরা যে এজাহার দিয়েছিলাম সেটিই রেকর্ড করেন। এ ঘটনার পরদিন আলিম উদ্দিনের পক্ষ থেকে আরেক সাজানো মামলা করা হয়। নয়াবস্তির সাবু মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম হামলায় আহত সালাম সহ ৯ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। এ মামলায় গুরুতর আহত সালামকে আসামি করায় স্থানীয়ভাবে ক্ষোভ দেখা দেয়। পূর্বের দায়ের করা মামলার বাদী কুঠিন মিয়াকেও আসামি করা হয়।

গতকাল তারা সিলেটের আদালত থেকে জামিন নেন। মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাসান আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সালামের ওপর যে নির্মমতা চলেছে সেটি গতকাল আমরা আদালতকে অবগত করেছি। হাত ও পা ভাঙা সালামকে কোলে করে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত সালাম সহ ৯ জনকে জামিন দিয়েছেন। তিনি জানান, এ সময় আদালতে কুঠিন মিয়ার মামলার আসামিদের মধ্যে ৬ জন এসে হাজিরা দেন। আদালত উপস্থিত হওয়া ছমেদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন। এব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার ওসি তদন্ত হিল্লোল রায় মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ঘটনার পর পুুলিশের কোনো ত্রুটি ছিল না। পুলিশ গিয়েই তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এবং দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে। মামলা দায়েরের পর থেকে পুলিশ আসামিদের খুঁজছে বলে জানান তিনি। স্থানীয় নয়াবস্তি গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, জাফলং কোয়ারির তীরেই অবস্থিত নয়াবস্তি। আগে সালামের ভাই, পিতা ও মামারা এলাকার পাথর উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতো। গত ৪-৫ বছর ধরে পাথর উত্তোলনের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ছাতকের আলাউদ্দিন, বিশ্বনাথের ফয়জুল, জামাই সুমন, আলিম উদ্দিন, ছমছু সহ কয়েক জনের হাতে। তারাই এখন জাফলং নদীতে লিস্টার মেশিন লাগিয়ে প্রতিদিন ১০-১২ লাখ টাকার পাথর লুটপাট করছিলো। এলাকার মানুষকে নিয়ে পাথর ও বালু উত্তোলনের প্রতিবাদী ছিলেন সালামের পিতা, মামা ও ভাইরা। এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। এই উত্তেজনার জের ধরে তারা সালামকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। নদীতে বালু লুটপাটকালে সালামের জাল ছিঁড়ে যাওয়ার ঘটনার জের ধরে তার হাত ও পা ভেঙে দেয়া হয়েছে। তবে সালাম সহ অন্যদের ওপর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন আলাউদ্দিন। তিনি জানিয়েছেন, জাফলংয়ে এখন পাথর লুটপাট করা হচ্ছে না। এ নিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে। দু’দফা পেটানো ঠিক হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status