প্রথম পাতা

র‌্যাগিংয়ের নামে বুয়েটে যেভাবে নির্যাতন হতো

পিয়াস সরকার

২০ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ৯:৩৪ পূর্বাহ্ন

আসাদুল হক আসাদ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)’র দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। থাকেন শের-ই-বাংলা হলে। আর্কিটেকচার বিভাগের এই শিক্ষার্থী হলের প্রথম রাতের কথা বলতে রীতিমতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেই রাতে তার মোবাইল ফোন দিয়ে ছোট বোনের ফোন রিসিভ করে অশ্লীল বিভিন্ন কথা বলা হয়। তিনি বলেন, সেই সময় আমার মনে হচ্ছিল। আত্মহত্যা করি। ছোট বোনের সামনে মুখ দেখাবো কী করে? বাবা মাকেই কী বলব।
শুধু আসাদ নন, তার মতো আরও অনেকে বুয়েটে পড়তে এসে ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পড়তে হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। নানা সময়ে র‌্যাগিং-এর শিকার হয়েছেন এমন অনেকের সঙ্গে কথা হয়েছে মানবজমিন এর। তাদের বয়ানে উঠে এসেছে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র।

নিজের জীবনের বাজে মুহুর্তের বর্ণনা দিয়ে আসাদ বলেন, আমি গ্রামের ছেলে। লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত এলাকায় লেখাপড়া করেছি। বুয়েটে পড়বার সুযোগ মেলায় এলাকায় ‘হিরো’ বনে যাই। ভর্তি হবার পর আমার এলাকার এক ভাইয়ের সঙ্গে হলে থাকতাম। ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, থাকেন জসীম উদ্দিন হলে। সেখানে মাসখানেক থাকবার পর হলে সিট পাই। প্রথম যেদিন হলে উঠি সেদিন আমার মতো আরো ৫ জন শিক্ষার্থী ছিলো। সবাই ছিলো আমার পরিচিত আর আমাদের রাখা হয় একই রুমে। আমাদের রুম গোছানো শেষ হয় প্রায় রাত ৮টায়। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেবার সময় ডাক পড়ে সকলের। সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে বেশ ক্লান্ত আমরা। প্রথমে বড় ভাইদের রুমে ডেকে নিয়ে যাবার সঙ্গে প্রত্যেককে একটি করে চড় মেরে স্বাগত জানানো হয়। এরপর শেখানো হয় নিয়ম কানুন। তখন রাত প্রায় ১২টা। এরপর শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। আমার হাতে ছিলো মোবাইল ফোন। প্রশ্ন করেন, হাতে কী? মোবাইল জবাব দেবার পর বলে এটা ক্যামেরা, এটা স্পিকার, এটা ব্যাটারী কিন্তু মোবাইল কোনটা। এভাবে হেনস্থার একপর্যায়ে আমার ছোট বোন ফোন করে। ফোন ধরে অনিক ভাই (বুয়েট ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, অনিক সরকার। বর্তমানে বহিষ্কৃত। আবরার ফাহাদ হত্যার আসামি, আটক অবস্থায় রয়েছেন) যেসব কথা বলে, সেসব কথা মুখে বলার মতো না। আমি তার পা ধরে অনুরোধ করি এসব কথা না বলতে। এরপর কিছু সময় পর মোবাইল কেটে দেয় বোন। এরপর ফের ফোন দেয়। আমার বোন ফোন না ধরে ও বন্ধ করে রাখে।

আসাদের চোখ তখন বেশ অশ্রুসিক্ত। কথা বলতে যেন গলা আটকে আসছিলো। এরপর তিনি বলেন, একটা বিষয় খেয়াল করি। আমার বোনের সঙ্গে এভাবে কথা বলায় অনেকেই বিব্রত হয়। সেসময় জিওন ভাই (মেফতাহুল ইসলাম জিওন, বহিষ্কৃত হবার আগে ছিলেন বুয়েট ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক। আবরার হত্যার আসামি, তিনিও গ্রেপ্তার) বলেই বসে, বেশি হয়ে গেলো না। এই বলে জিওন ভাই চলে যায় রুম থেকে। আমার কারণে জিওন ভাই রুম থেকে চলে যাওয়ায় আরো ক্ষিপ্ত হয় অনিক ভাই। প্রায় ১০ মিনিট ধরে আমাকে থাপড়াতে থাকে। আমার গাল ফেটে রক্ত বের হবার পর ছেড়ে দেয়। অনিক ভাইও রুম থেকে চলে যায়। এরপরেও বাকীরা ভোর পর্যন্ত আমাদের সকলের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। এরপর আমার বোনকে বলি, মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। কে ফোন ধরেছে জানি না। এখন নতুন আরেকটা ফোন নিয়েছি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষের স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, আমি কাজী নজরুল ইসলাম হলে থাকি। ছাত্রলীগের বড় ভাইয়েরা গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে বসে গাজা খাচ্ছিলেন। আর হলের বড় ভাই, ছাত্রলীগের নেতার র‌্যাগিংয়ের অংশ হিসেবেই সেখানে গিয়েছিলাম। কেন সেখানে এত রাতে আমরা। এই নিয়ে শুরু হয় নির্যাতন। আমার সঙ্গে থাকা ২ জনকে নিয়ে যাওয়া হয় তিতুমীর হলে। সেখানে তারা কোন কথা না শুনেই মারতে থাকে। বাঁশের লাঠি ও স্টিলের স্লেল এক করে পেটাতে থাকে।

আমারা বারবার বড় ভাইদের নির্দেশেই গিয়েছিলাম বললেও কোন কথার জবাব দেয়না তারা। আমাদের ৪ জন ধরে নিয়ে যাবার পর সেই রুমে মোট ৯ জন উপস্থিত হন। এরপর তারা ৯ জন আর আমরা ৩ জন। এই নিয়ে ৩’র ঘরের নামতা পড়তে পড়তে পিঠানো শুরু। প্রথমে একজন ৩ টি আঘাত, এরপরজন ৬টি এভাবে শেষজন একাই মারেন ২৭টি। এভাবে চলতে থাকায় ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম। একজন মার সহ্য করতে না পেরে বমি করে দেয়। বমি করায় তার ওপর নেমে আসে অবর্ননীয় নির্যাতন। সেখানে সেই অবস্থায় তাকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নেয়া হয়। এরই মাঝে মাথা ঘুরে পড়ে যায় সে। এরপর তারাই একটি সিএনজি ডেকে আনে। আর তাতে আমাদের তুলে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেলে। আমাদের হাতে দেয় ৫শ’ টাকা। সেখানে আমার বন্ধু চিকিৎসাধীন থাকে ৮দিন। এরপর সে আর হলে উঠে নি। মেসে থেকে লেখাপড়া করছে।

তিতুমীর হলে থাকেন মিনার মাহমুদ। তিনি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। এটি তার প্রথম বর্ষের শেষের দিকের ঘটনা। প্রথম বর্ষ প্রায় শেষ হওয়ায় র‌্যাগিংও প্রায় শেষ। এইসময় একদিন ক্যান্টিনে খেতে গিয়েছিলেন মিনার। হলের বড় ভাইয়ের একটি দল সেখানে খেতে আসে। তার কানে হেডফোন থাকায় বড় ভাইয়েরা উঠতে বলেছিলেন তা শুনতে পাননি। মিনার বলেন, খাওয়া অবস্থায় আমাকে প্রথমে লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয়। এরপর সোজা চড়, কিল, ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে যায় একটি রুমে। সেখানে উলঙ্গ করে মারতে থাকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক মারার পর পানি খেতে চাই। তখন তারা বলে, পানি খাবি। আয় তোরে পানি খাওয়াই। এই বলে নিয়ে যাওয়া হয় বাথরুমে। সেখানে নিয়ে আটকে রাখে ৬ ঘণ্টা। আর কিছু সময় পর পর তারা এসে গান গাওয়ার জন্য বলে। উচ্চ শব্দে গান গাইতে হয়। হেড ফোন লাগিয়ে গান শুনছিলাম এই অপরাধেই গান গাইতে হয় আমাকে। আর মাঝে মধ্যে দরজা খুলে মারতে থাকে তারা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status