প্রথম পাতা

টাকার মান কমানোর উদ্যোগ যা ভাবছেন বিশ্লেষকরা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৫ অক্টোবর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:১৬ পূর্বাহ্ন

দীর্ঘদিন আটকে রাখার পর আমদানি পর্যায়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি ডলারে বেড়েছে ২০ পয়সা। সে কারণে গত সপ্তাহে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক ডলার ৮৪ টাকা ৫০
পয়সায় কিনতে পারলেও এখন খরচ করতে হয়েছে ৮৪ টাকা ৭০ পয়সা। সংশ্লিষ্টদের মতে, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে রপ্তানিকারক ও রেমিটেন্স প্রেরণকারীরা লাভবান হলেও আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ ভোক্তারা। কারণ পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে যাবে। বিশেষ করে আমদানিনির্ভর খাদ্যদ্রব্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। তবে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অনেকটা বাধ্য হয়েই এই কাজটি করা হচ্ছে বলে তারা মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ গত মাসেই এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পাঠিয়েছে। তবে ঠিক কত টাকা অবমূল্যায়ন করা হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। রপ্তানিকারকরা জানান, দেরিতে হলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা একে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বিশ্লষকরা জানান, টাকার অবমূল্যায়ন হলে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হন। কারণ, আগের তুলনায় ডলারের বিপরীতে বেশি হারে টাকা পাওয়া যায়। তবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। কারণ আমদানিকারকদের আগের তুলনায় বাড়তি অর্থ দিয়ে ডলার কিনতে হয়। বাংলাদেশে এখনো রপ্তানির তুলনায় আমদানি  বেশি। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেলসহ শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের বড় অংশই আমদানি করতে হয়। অবমূল্যায়ন হলে মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধিরও আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ মূলত মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতেই টাকার অবমূল্যায়ন থেকে দূরে থাকে।

আমদানিকারকরা জানান, বাংলাদেশকে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য আমদানি করতে হয়। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমলে আমদানিতে খরচ বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় রাখা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা সত্য ডলারের দাম বাড়ালে আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ে। সাধারণ মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে। আবার বিপরীতে রপ্তানিকারকরা লাভবান হবেন। রেমিটেন্স বেশি আসবে। এখন বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত-ডলারের দাম বাড়ালে লাভ-ক্ষতি কী পরিমাণ হবে। এদিকে চীন, ভারত, ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর মতো রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের সুবিধা দিতে এই পথ বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ভবিষ্যতে টাকার বিপরীতে ডলার আরো শক্তিশালী হবে বলে আভাস দিয়েছেন ব্যাংকাররা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো জরুরি ছিল। আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। প্রতিযোগী দেশগুলো বিশ্ববাজার দখল করতে তাদের মুদ্রার মান অনেক আগেই কমিয়েছে, আমরা করিনি। এখন রপ্তানি আয় কমে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। তিনি বলেন, আমাদের যারা প্রতিযোগী, যেমন চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম বেশ কয়েকবার তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে। ভারত সমপ্রতি কমিয়েছে। আর সম্প্রতি চীন তাদের মুদ্রার মান কমিয়েছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে নগদ সহায়তার পরিবর্তে টাকার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী করা দরকার। আর এতে রপ্তানিকারকরা এমনিতেই সুবিধা পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এক বছর আগে ২০১৮ সালের ২রা অক্টোবর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৩ টাকা ৮০ পয়সা। ধীরে ধীরে বেড়ে চলতি বছরের এপ্রিল শেষে তা ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা হয়। এরপর টানা ৫ মাস টাকা-ডলারের বিনিময় হার একই জায়গায় স্থির রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওদিকে খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেশ বেড়ে গেছে। সোমবার প্রতি ডলার ৮৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগেও খোলাবাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা। খোলাবাজারে ডলার আসে মূলত বিদেশফেরতদের কাছ থেকে। তারা দেশে যে ডলার নিয়ে আসেন, তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। মানি চেঞ্জারগুলোও বিদেশফেরত লোকজনের কাছ থেকে ডলার কিনে থাকে।

সরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি অনেক বড় আমদানির দায় পরিশোধ হচ্ছে। এ কারণে অনেককে খোলাবাজার থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। তবে খোলাবাজারে সরবরাহ তেমন নেই। এতে দাম বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকগুলোর কাছে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার দরে ৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি খোলাবাজার ও মানি চেঞ্জারের লেনদেনও পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পুরো জুলাই মাসে প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৩০ পয়সা দরে বিক্রি হয়। আগস্টে তা বেড়ে ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত হয়। গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে কোনো কোনো দিন প্রতি ডলার ৮৭ টাকায়ও বিক্রি করে মানি চেঞ্জারগুলো। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ২৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে ২৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার সরবরাহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-অগাস্ট) ডলারের তেমন চাহিদা ছিল না। সেপ্টেবরে বেড়েছে। চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে। নানান কিছু বিবেচনায় নিয়ে টাকার বিপরীতে ডলারের বিপরীতে টাকাকে দুর্বল করতে দেয়া হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৯৬৪ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। রপ্তানির এই অংক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ শতাংশ কম। আর গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে ৩ শতাংশ কম।

এর আগে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমাতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) পক্ষ থেকে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। সিপিডি’র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান পুননির্ধারণের বিষয়টি আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কিছুটা কমলে আর্ন্তজাতিক বাজারে রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা করা সহজ হবে।  গত ১২ই সেপ্টেম্বর প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় টাকার শক্তিশালী অবস্থানের কারণ উল্লেখ করে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানকে চিঠি দেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status