এক্সক্লুসিভ

রোহিঙ্গাদের এনআইডি জয়নালের জবানবন্দিতে ইসির ১৫ সদস্যের চক্র

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে

২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৭:৩৩ পূর্বাহ্ন

রোহিঙ্গাদের এনআইডি তৈরিতে নির্বাচন কমিশনের ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম জয়নালের মুখে। তাদের মধ্যে পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও নজরদারিতে রয়েছেন আরো ১১ জন। যাদের মধ্যে ইসির একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তাও রয়েছেন।
শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আবু সালেম মো. নোমানের আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে ইসির ডবলমুরিং থানার অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনের মুখে এসব নাম উঠে আসে। তবে, তাদের নাম প্রকাশ করেনি মামলার তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম (সিটি) ইউনিট।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, আদালতে জয়নাল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। নিজের দোষ স্বীকার করার পাশাপাশি তাকে যারা সহযোগিতা দিতো তাদের নামও প্রকাশ করেছেন। তদন্তের স্বার্থে আমরা কারো নাম প্রকাশ করছি না। যাদের নাম পাওয়া গেছে সবাইকে আমরা আইনের আওতায় আনবো।
তিনি বলেন, জয়নালকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া। তবে ৩ দিনের মাথায় নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন জয়নাল। এমনকি তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার মোস্তফা ফারুক (৩৬) নামে ইসির এক অস্থায়ী কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকেও ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) মো. কামরুজ্জামান বলেন, শনিবার বিকাল ৩টার দিকে ইসি কর্মী জয়নালকে আদালতে আনা হয়। এ সময় বিচারক তাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেবেন কিনা তা ঠিক করার জন্য সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময় দেন। এরপর তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজি হন। পরে বিচারকের খাসকামরায় জবানবন্দি দেয়া শেষে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। রাত ৮টার পর তাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে জয়নাল এনআইডি জালিয়াতির সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নির্বাচন অফিসের বেশ কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এই চক্রের অনেকের নাম প্রকাশ করেছেন। অন্তত ১৫ জনের নামের এই তালিকায় ইসির কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা, স্থায়ী ও আউটসোর্সিংয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন কর্মচারী ও সাবেক কর্মরত কয়েকজন কর্মীর নামও আছে।
ইতিমধ্যে ১৫ জনের মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাদের সবাই থানা পর্যায়ের কর্মকর্তার নিচের র‌্যাংকের কর্মকর্তা। বাকি ১১ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজন কাউন্টার টেরোরিজমের নজরদারিতে রয়েছে। কর্মকর্তাদের অনেকে এখন চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে ঢাকাসহ অন্য জেলায় চলে যাচ্ছে।
গ্রেপ্তারের পর পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জয়নাল জানায়, কোতোয়ালি থানার দেওয়ানবাজার সাব-এরিয়া এলাকার আমেনা মঞ্জিলের ষষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাটেই থাকতো সে। সেই ফ্ল্যাটে নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে ডিএসএলআর ক্যামেরা, ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাডও আনতেন। সপ্তাহের সরকারি বন্ধের ২ দিন শুক্র ও শনিবারসহ বন্ধের দিনগুলোতে নিজ ফ্ল্যাটে বসে জাতীয় পরিচয়পত্রের যাবতীয় প্রাথমিক কার্যক্রম (ডাটা ক্রিয়েট) সম্পন্ন করতেন।
জয়নাল এই দায়িত্ব পালন শেষে সব তথ্য ঢাকার নির্বাচন কমিশন অফিসের এনআইডি শাখায় কর্মরত সাগরের কাছে মেইলে পাঠিয়ে দিতেন। তারপর অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের ব্যবহৃত ল্যাপটপ সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে তথ্য আপলোডসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতেন সাগর। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রিন্ট কপি এসএ পরিবহনের (কুরিয়ার) মাধ্যমে চট্টগ্রামে জয়নালের কাছে পাঠাতেন সাগর।
আর গ্রাহক সংগ্রহ ও পৌঁছে দেয়ার কাজটি করতেন সত্য সুন্দর দে, বিজয় দাশ ও সীমা দাশ। তারা চট্টগ্রাম, ঢাকা, কক্সবাজারের বিভিন্ন লোকজনের মাধ্যমে দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে প্রত্যেকটি এনআইডি কার্ডের জন্য ৫০-৬০ হাজার টাকা আদায় করতেন।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের ভোটার করার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর থেকে দেশজুড়ে সমালোচনা তৈরি হয়। দুদক, নির্বাচন কমিশন আলাদাভাবে বিষয়টি তদন্ত করে। তদন্তের একপর্যায়ে গত ১৬ই সেপ্টেম্বর রাতে নির্বাচন কমিশন নিজেদের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন ও তার দুই সহযোগীকে আটক করে পুলিশে হস্তান্তর করে। পরে ১৭ই সেপ্টেম্বর তাদের নামে নগরীর কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়। ওই মামলায় আদালতের আদেশে জয়নাল ৩ দিনের পুলিশি হেফাজতে থাকার পর শনিবার স্বীকারোক্তি দেয়। তাছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম পর্যায়ে জয়নাল মোস্তফা ফারুকের নাম প্রকাশ করে। এরপর বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে আনায় নির্বাচন কমিশনের এনআইডি প্রকল্পের কর্মী মোস্তফা ফারুককে। বৃহস্পতিবার রাতেই মোস্তফা ফারুকের হামজারবাগের বাসায় অভিযান চালিয়ে ল্যাপটপ, পেনড্রাইভ, নির্বাচন কমিশনের ব্যবহৃত একটি মডেম, আইডি কার্ড লেমিনেটিং করার ৫০টি কাগজ, তিনটি সিগনেচার প্যাড ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে মোস্তফা ফারুকের নিজের দুই এনআইডি পেয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। শুক্রবার তাকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।


 
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status