শেষের পাতা

ডেঙ্গু: এবার ‘শক সিন্ড্রোমে’ মৃত্যু বেশি

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ১১:৫৫ পূর্বাহ্ন

এবছর শুরু থেকেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীর ধরন ছিল ভিন্ন। এডিস মশাবাহিত এই জ্বরকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও আগ থেকেই ডেঙ্গুর প্যাটার্নটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে আসছিলেন। তারা বলেছেন, এবার তারা  ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত রোগী বেশি পেয়েছেন। এখনও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। তাদের কাছে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ২০৩টি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়। সেখান থেকে আইইডিসিআরের ডেথ রিভিউ কমিটি এ পর্যন্ত ১১৬টি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করে ৬৮টি মৃত্যু ডেঙ্গুর কারণে হয়েছে বলে জানায়। ৬৮টি মৃত্যুর মধ্যে আইইডিসিআর থেকে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তদের বয়সের হিসাবে দেখা যায় এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এক বছরের কম বয়সী দুই শতাংশ, এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে সাত শতাংশ, পাঁচ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ১৭ শতাংশ, ১৫ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৩১ শতাংশ, ২৫ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ২১ শতাংশ, ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ১০ শতাংশ, ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে সাত শতাংশ, ৫৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের আক্রান্তের হার তিন শতাংশ এবং ৬৫ বছর থেকে এর বেশি বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছেন দুই শতাংশ। এসব বয়সের মানুষের মধ্যে এবার বেশি মৃত্যু হয়েছে ‘ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে’ আক্রান্ত হয়ে। আইইডিসিআর জানায়, এবার যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তাদের ৬৮ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে ‘ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে’। আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এবার শুরু থেকেই ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে, যে কারণে সাধারণ মানুষসহ চিকিৎসকরাও অনেকটা দ্বিধায় ছিলেন। এবার ডেঙ্গু হলেই আগের চেনা ধরন দেখা যায়নি। এবার ডেঙ্গু জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে হার্ট, কিডনি ও ব্রেইন। রোগীর মাল্টি অর্গান ডিসফাংশন হয়েছে। যে কারণে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি যে বেড়েছে তা বোঝা যায়নি। কিন্তু যখন রোগীকে হাসপাতালে আনা হয়েছে, তখন চিকিৎসা করার মতো কিছু অবশিষ্ট থাকেনি। আর শিশুদের বেলায় এটি ছিল আরও ভয়ঙ্কর। ডেঙ্গুর ধরন নিয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আগে যেসব উপসর্গ দেখা যেত, সেসব এখন হয় না বলে মানুষ বুঝতে পারছেন না। তাই চিকিৎসকের কাছে যেতেও দেরি করছে। কিন্তু এই দেরিতেই সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আরো বলেন, এবারে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। শরীরে একদমই র‌্যাশ নেই, হয়তো কিছুটা মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা হচ্ছে। হঠাৎ করেই শকে চলে যাচ্ছে। গত ১৬ই জুলাই হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে মারাত্মক অবস্থায় ভর্তি হয় শিশু সুমাইয়া। তার পেটে ও লাংয়ে পানি জমেছিল। শিশুর বড় ভাই সাগার জানান, সুমাইয়াকে বিশেষ নজরে রেখেছিল চিকিৎসকরা। ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়েছিল সে। রক্তের ২টি প্লাটিলেট দিতে হয়েছে। ৪টি প্লাজমাও লেগেছিল তার। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এল ই ফাতমী মানবজমিনকে বলেছেন, এবার প্রায় সবাই ডেঙ্গু হেমারজিক ফিভারে আক্রান্ত। আগে ছিল ক্লাসিকাল ডেঙ্গু রোগী। এদের পঞ্চাশ ভাগেরই শক সিন্ড্রোম। শক সিন্ড্রোম অর্থ হচ্ছে পালস (নাড়ির গতি) পাওয়া যায় না। হৃদপিণ্ডের গতি অনেক বেড়ে যায়, ব্লাডপ্রেসার কমে যায়, পানিশূন্যতা দেখা দেয়, তখন তাকে ‘শক’ বলা হয়। এই শক সিন্ড্রোমের রোগী এবার বেশি। এদের সবার প্ল্যাটিলেট কমে যাচ্ছে, সবাই শকে চলে যাচ্ছে। আগে সামান্য ডেঙ্গু হয়েই ভালো হয়ে যেত। এবার সবারই রক্ত লাগছে। গত ২৩শে আগস্ট ঢাকা শিশু হাসপাতালে মারা যায় ৮ বছরের মো. আবরার হক কাওসার আলী শেখ আরিয়ান। আরিয়ানের ডেথ সার্টিফিকেটে চিকিৎসকরা মৃত্যুর কারণ হিসেবে লিখেছেন ‘ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম’। একই হাসপাতালে গত ১৬ই আগস্ট মারা যায় ছয় মাস বয়সী আয়য়াজুর রহমান। আয়য়াজুর ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩০ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ১৩২ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৯৮ জন। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ৪০৮ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সারাদেশে ৮৪ হাজার ৮২৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন ৮২ হাজার ৫২৫ জন। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় গেছেন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন দুই হাজার ৯৯ জন রোগী। চিকিৎসাধীন এবং নতুন ভর্তি রোগী দুটোই ঢাকার বাইরে বেশি। বর্তমানে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন আছেন ৮৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী। ঢাকার বাইরে চিকিৎসাধীন আছেন এক হাজার ২২৪ জন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status