দেশ বিদেশ

পুলিশ প্লাজাসহ চট্টগ্রামে দুই শতাধিক জুয়ার আসরে তালা

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, রবিবার, ৮:৫৪ পূর্বাহ্ন

পুলিশের তালিকায় চট্টগ্রামে জুয়ার আসর মাত্র ৩২টি। কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা দুই শতাধিক। যেখানে রাত-দিন লেনদেন হয় লাখ লাখ টাকা। এসব আসরে চলে মাদকের কারবার। ক্লাবভেদে চলে পতিতার ব্যবসাও। আর এসব অপরাধে জড়িতদের বেশিরভাগই কোটিপতি প্রভাবশালী। তবে ঢাকায় ক্যাসিনোতে অভিযান ও প্রভাবশালীদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় চট্টগ্রামের প্রভাবশালী জুয়াড়িরাও গা ঢাকা দিয়েছে। ক্লাব ও বারে অভিযান শুরুর আতঙ্ক থেকে নগর দাপিয়ে বেড়ানো জুয়াড়িদের এখন আর দেখা মিলছে না। আসরগুলোতেও ঝুলছে তালা। এরমধ্যে শুক্রবার রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানার আলমাস সিনেমা হলের পাশে হেং আউট পুল এন্ড স্নোকার ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ২৭ জনকে আটক করে। পরে খালেকুজ্জামান (৩০) ও রবিউল হোসেন (২৫) নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করে বাকিদের ছেড়ে দেয় পুলিশ। কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন জানান, স্পোর্টিং ক্লাব হিসেবে পরিচিতি হেং আউটের মালিক চট্টগ্রাম মহানগর সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব গোলাম রসুল বাবু। তিনি নগরীতে চট্টলা পরিবহন নামে একটি বাস কোম্পানির মালিক।
গ্রেপ্তারকৃত খালেকুজ্জামান তার ছেলে। এ ঘটনায় প্রভাবশালী জুয়াড়িরা গা ঢাকা দেয়। জুয়ার ক্লাবে ঝুলছে তালাও।

তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুবর রহমান বলেছেন, পুলিশ প্লাজাসহ নগরীর সকল ধরনের জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরপরও জুয়ার আসর চালু রাখায় হেং আউটে অভিযান চালানো হয়। এতে ভিত নড়ে উঠে প্রভাবশালী জুয়াড়িদের। পুলিশের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মহানগরীর কোতোয়ালি থানা এলাকায় একটি, সদরঘাট থানায় তিনটি, চান্দগাঁও থানায় তিনটি, বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকায় একটি, ডবলমুরিংয়ে একটি, হালিশহরে সাতটি, পাহাড়তলীতে চারটি, পতেঙ্গায় দুটি, কর্ণফুলীতে একটি, ইপিজেডে ছয়টি ও বন্দরে তিনটি জুয়ার আসরের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চট্টগ্রামে দুই শতাধিক ক্লাব রয়েছে যারা প্রতিদিন জুয়ার বোর্ড থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করে। প্রতিষ্ঠিত ক্লাব ছাড়াও নগরীর কয়েকটি অভিজাত এলাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়ি কিংবা অফিসের নির্দিষ্ট কক্ষে জুয়ার আসর বসে। জুয়ার আসর বসার অভিযোগ ওঠা অন্যতম ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে, পুলিশ প্লাজা, আবাহনী ক্লাব, মোহামেডান ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ক্লাব, ওয়াজি উল্লাহ ইনস্টিটিউট, বন্দর রিপাবলিক ক্লাব ও ফ্রেন্ডস ক্লাব অন্যতম। এ ছাড়াও হাজারী লেনের একাধিক স্থানে প্রতিরাতে জুয়ার আসর বসে। খুলশী, অক্সিজেন, পাথরঘাটা, নালাপাড়া, হালিশহর, আগ্রাবাদ, বড়পোল, ছোটপোল, বিআরটিসি মার্কেট, পাহাড়তলী, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, বহদ্দারহাট, জামতলা বস্তি, ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন, বায়েজিদসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ক্লাবে, বাসা বাড়িতে জুয়ার আসর বসে। পাড়া মহল্লায়ও বসে জুয়ার আসর। দিন ও রাতে এসব আসরে স্তরে স্তরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জুয়া খেলে জুয়াড়িরা। কিছুক্ষণ পর পর চা এনে দেয় বয়রা। জুয়ার আসরে লেনদেন হয় লাখ লাখ টাকা। কেউ রাতারাতি লাখপতি বনে যায়। কেউ নিঃস্ব হয়ে ঘরে ফিরে। ক্লাব ভেদে চলে মাদক কারবার ও পতিতার ব্যবসাও। সংশ্লিষ্টদের মতে, নগরীর হালিশহরের জে ব্লকের আবাহনী ক্লাবটিতে চট্টগ্রামের প্রভাবশালী এক যুবলীগ নেতার মদত রয়েছে। এ ক্লাবের জুয়ার আসরের লেনদেন কোনো দিন কোটি টাকা পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়। তবে বৃহসপতিবার সন্ধ্যা থেকে ক্লাবটির ভেতরে তিন-চারটি কক্ষে থাকা জুয়ার আখড়াগুলো বন্ধ করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নগরীর এ কে খান মোড় এলাকায় একটি ভবনের তিনতলা ও চারতলা ভাড়া নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ক্লাব নাম দিয়ে জুয়ার আসর বসানো হয়। প্রতিদিন শতাধিক লোক সেখানে জুয়া খেলে ও মাদক গ্রহণ করে। বায়েজিদের আমিন কলোনি এলাকার আশপাশে অন্তত ছয়টি স্থানে জুয়ার আসর বসে। আমিন কলোনি বেলতলা এলাকা, আমিন কলোনির মাঠ এলাকা, টেক্সটাইল জিএম বাংলো পাহাড়ের উপর, রউফাবাদ রেলক্রসিং এলাকা, স্টারশিপ গলি,শান্তিনগর কলোনিতে জুয়ার আসর বসে বলেও স্থানীয়রা তথ্য দিয়েছেন। বাকলিয়া থানা এলাকার শাহ আমানত সেতু এলাকা ঘিরে রয়েছে ১২টি জুয়ার আসর। এরমধ্যে চাক্তাই সি-বিচ কলোনির জুয়ার আসর অন্যতম। এ ছাড়া কর্ণফুলীর তীরে সীমার বাপ নামে পরিচিত খোরশেদ আলম, আবদুর রহমান ও কায়সারের মালিকানাধীন জুয়ার আসর রয়েছে। এ ছাড়া চাক্তাই চামড়ার গুদাম এলাকায় রয়েছে মমিন ও মামুনের জুয়ার আসর। কোতোয়ালি থানাধীন জলসা মার্কেটের ষষ্ঠ তলায়, গোয়ালপাড়া এলাকায়, আলকরণে সিলকন হোটেল গলিতে, কাজির দেউড়ি এলাকায়, স্টেশন রোডের ফলমন্ডি এলাকায় রেলওয়ে মেন্স সেন্টার, পলোগ্রাউন্ড মেলা কমিউনিটি সেন্টার, এনায়েত বাজার বাটালি রোড, নন্দনকানন আরএফ পুলিশ প্লাজায় চলে জুয়ার আসর। ডবলমুরিং থানাধীন দেওয়ানহাট ব্রিজের নিচে, আগ্রাবাদ সাউথ ল্যান্ড সেন্টার ভবনের পঞ্চম তলায়, পান্না পাড়ায়, মনসুরাবাদ মাঠের সামনে, ভেলোয়ার দীঘির পাড়ে, ঝর্ণাপাড়া, হাজী পাড়ায়, পাঠানটুলী জুয়ার আসর বসে। এ ছাড়াও সদরঘাট রোডে হোটেল শাহজাহান, চকবাজার আলিফ প্লাজা, চান্দগাঁও আবাসিক এ ব্লকে দৃষ্টি ভবন, শমসের পাড়া জানু মিস্ত্রির বাড়ি, বহদ্দারহাট মদিনা হোটেলের পাশের বিল্ডিং, খুলশী ৪ নম্বর, মেহেদীবাগ ন্যাশনাল হাসপাতাল সংলগ্ন গলি, ডিসি রোড খালপাড়ে চলে জুয়ার আসর।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোস্তাইন হোসাইন বলেন, জুয়া এ দেশে নিষিদ্ধ। ১৮৬৭ সালে প্রণীত বঙ্গীয় প্রকাশ্য জুয়া আইন বাংলাদেশে এখনো প্রযোজ্য। সেই আইন অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে ক্রীড়ারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। পুলিশ জুয়ার সামগ্রীর খোঁজে যেকোনো সময় তল্লাশি চালাতে পারবে বলেও আইনে উল্লেখ রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা কোথাও জুয়ার আসর বসতে দেবো না। এটি একটি অবৈধ পন্থা। ইতিমধ্যে পুলিশ নগরীর একাধিক ক্লাবে অভিযান চালিয়েছে। এরমধ্যে পরিবহন নেতার মালিকের স্পোর্টিং ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ২৭ জনকে আটক করা হয়। তারমধ্যে ২৫ জন খেলতে এসেছিল। তাদের ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাকি দুইজনকে থানায় নেয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে এই দু’জনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status