প্রথম পাতা

মাফিয়া ডন শামীম গ্রেপ্তার

রুদ্র মিজান ও আল-আমিন

২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শনিবার, ৯:০৭ পূর্বাহ্ন

মাফিয়া ডন। বন্দুক শামীম। সম্রাট। গণপূর্তের যুবরাজ। নানা পরিচয় তার। রাজনীতির আড়ালে ঢাকা পড়েছিল তার পাপের লম্বা খতিয়ান। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ‘যুবলীগ নেতা’, প্রভাবশালী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম ধরা পড়েছেন অ্যালিট বাহিনী র‌্যাবের হাতে। গুলশানের নিকেতনের কার্যালয় থেকে গতকাল কয়েকঘন্টার অভিযান শেষে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এসময় গ্রেপ্তার করা হয় তার সাত দেহরক্ষীকেও। এই অস্ত্রধারী দেহরক্ষীরাই সবসময় ঘিরে থাকতো তাকে। তার বাণিজ্যিক কার্যালয় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর, নগদ পৌনে দুই কোটি টাকা, অস্ত্র এবং মদ। তার বিপুল সম্পদ আর বিলাসী জীবনের কাহিনী দেখে চমকে ওঠেছেন সবাই। যুবলীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শামীম যুবলীগের কেউ নন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুবলীগের সমবায় সম্পাদক পরিচয়ই ছিল তার ক্ষমতার উৎস। যদিও একসময় তিনি যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে তার সহ-সভাপতি পদ থাকার তথ্যও সামনে এসেছে।

শামীমের কার্যালয় থেকে যা কিছু উদ্ধার: গতকাল সকাল ৭ টার দিকে র‌্যাবের একটি দল গুলশানের নিকেতনের ৫ নম্বর রোডের ১১৩ নম্বর বাসা ঘিরে ফেলে। ওই বাসার তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় জিকে শামীম তার পরিবার নিয়ে থাকেন। দুইটি ফ্ল্যাটকে তিনি ডুপ্লেক্স বাসা বানিয়েছিলেন। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সব কিছু গোপন করার চেষ্টা করেন। ওই বাসায় র‌্যাবের সদস্যরা তল্লাশি শেষ করে শামীমের অফিস ১১৪ নম্বর বাড়িতে যান। ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলা ও তৃতীয় তলায় শামীমের বিলাসবহুল অফিস। সেখানে অভিযান চালিয়ে নগদ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের এফডিআর, ১টি রিভলবার, ৪ টি বিদেশি মদের বোতল ও বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই উদ্ধার করা হয়। এসময় শামীমসহ তার ৭ দেহরক্ষীকে আটক করা হয়। র‌্যাব দেহরক্ষীর অস্ত্রগুলো জব্দ করে। আটককৃত দেহরক্ষীরা হলেন, শহিদুল ইসলাম, মুরাদ, দেলোয়ার, জাহেদ, সায়েম, আমিনুল ও কামাল। ভিআইপি এলাকায় র‌্যাবের অভিযানের কারণে ওই এলাকার লোকজন সেখানে ভিড় করে। তাদের ভিড় সামলাতে র‌্যাবের সদস্যদের বেগ পেতে হয়। অভিযান শেষে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম সাংবাদিকদের জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সকাল থেকে আমরা শামীমের বাসা ও অফিসে অভিযান শুরু করি। এ সময় শামীম ও তার সাত জন দেহরক্ষীকে আটক করা হয়।

তিনি জানান, অভিযানে শামীমের অফিস থেকে তার একটি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও দেহরক্ষীদের সাতটি শটগান এবং নগদ এক কোটি আশি লাখ টাকা, মোট ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআরের (১৪০ কোটি টাকার এফডিআর মায়ের নামে, বাকি ২৫ কোটি টাকার এফডিআর শামীমের নামে) কাগজ ও বিদেশি মদের কয়েকটি বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগ রয়েছে। আমরা সেসব তদন্ত করছি। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাকে আটক করা হয়েছে। যেসব টাকাগুলো উদ্ধার হয়েছে সেগুলো বৈধ না অবৈধ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, অবৈধভাবে টাকাগুলো আয় করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তদন্ত প্রক্রিয়াধীন। তদন্ত শেষে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে।

এসময় র‌্যাবের ভ্রামমাণ আদালতের মাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, শামীমের মায়ের নামে রয়েছে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর। তবে তার মায়ের নামে কোনও প্রতিষ্ঠান নেই। বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবো। শামীমের রাজনৈতিক পরিচয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার কোনও রাজনৈতিক পরিচয় আছে কিনা তা নির্ধারণ করবে তার দল ও নেতারা। এ দায়িত্ব আমাদের নয়। উদ্ধার হওয়া তার অস্ত্রের লাইসেন্স আছে কী-না প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, তার অস্ত্রের লাইসেন্স থাকলেও ওইসব অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করা হতো বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিজেকে নির্দোষ প্রমানিত করলে তিনি ছাড়া পাবেন। আটক যুবলীগের নেতা খালেদের তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়েছে কী-না প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন উত্তর দেননি। শামীমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো দিদারুল ইসলাম জানান, স্যার বাসায় ঘুমাচ্ছিলেন। র‌্যাবের কর্মকর্তারা তাকে ঘুম থেকে তুলে অফিসে নিয়ে আসে।

শামীমের উত্থান ও বিলাসী জীবন: মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শামীম ঢাকায় শাহজাহানপুর, বাসাবো এলাকায় বড় হয়েছেন। শিক্ষক পরিবারের এই সন্তান থাকতেন টিনশেডের ঘরে। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন আলাদীনের প্রদীপ পেয়ে যান হাতে। বদলে যায় তার জীবন-যাপন। এখন শত-শত কোটি টাকার মালিক জি কে শামীম। থাকেন বিলাসবহুল বাড়িতে, হাকান দামি গাড়ি। তার সেবায় রয়েছে অর্ধশত কর্মচারী। এরমধ্যে সাত জন রয়েছে তার সিকিউরিটি গার্ড। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার প্রথম পাঁচ বছরেই নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেন শামীম। বাসাবো, কমলাপুর, ফকিরাপুল এলাকায় চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে জড়িত তার লোকজন। তবে বাসাবো এলাকায় দীর্ঘদিন থেকে পা দেন না শামীম। যদিও এখান থেকেই তার উত্থান। এখন ওই এলাকা নিয়ন্ত্রন করে তারই লোকজন। বাসাবো এলাকায় সদ্য নির্মিত শামীমের ৫তলা ভবনে একটি ইউনিট গড়ে তোলা হচ্ছিলো তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের বিনোদনের জন্য।

ওই ইউনিটের ডেকোরেশনের কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগেই জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ায় আতঙ্কে তার সঙ্গীরা। গতকাল বাসাবোর ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে নিচ তলায় রয়েছে গ্যারেজ ও পার্লার। রয়েছে সিঁড়ি ও লিফট। বাড়িটি দেখাশোনা করেন জি কে শামীমের এলাকার লোক নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের মোহাম্মদ সায়েম। সায়েম জানান, তিন মাস যাবত এখানে আছেন। মাঝে-মধ্যে যুবলীগের স্থানীয় নেতারা ওই বাসায় গিয়ে আড্ডা দেন। বাসাটি নতুন হওয়ায় সিনিয়ররা আসেন না। তারা অন্য বাসায় আড্ডা দেন বলে জানান তিনি। এ বাড়ির তৃতীয় তলায় একটি ইউনিট তাদের জন্য করা হয়েছে বলে জানান সায়েম। বাসাবো এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, বাসাবো এলাকায় দুটি বাসা রয়েছে যেখানে রাত হলেই শামীমের লোকজন নারী ও মদে মত্ত হয়ে থাকতো। শামীমের কথার অবাধ্য হলে প্রকাশ্যে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। বাসায় আটকে রাতভর নির্যাতন করে ছেড়ে দিতো। এমনকি রাজনৈতিক মামলায় আসামি করা হতো তাদের। এজন্য প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলেন না। ফকিরাপুলের একজন ব্যবসায়ী জানান, তার দোকানের সামনে ফুটপাতে দোকান বসিয়েছিলো শামীমের লোকজন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করায় তার ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কমলাপুরে টর্চার সেলে।সেখানে বেদম মারধর করা হয়। এ ঘটনায় মামলার করারও সাহস পাননি এই ব্যবসায়ী।

এলাকাবাসী জানান, শামীমকে সন্ত্রাসী হিসেবেই জানেন এলাকার লোকজন। এই সরকারের আমলে আঙুল ফুলে কালাগাছ হয়েছেন তিনি। বাসাবো, শাহজাহানপুর এলাকাতে সাতটি বাড়ি রয়েছে তার। ওই এলাকায় শামীমের হয়ে নিয়ন্ত্রন করেন দুই জন। শামীমের সময় কাটে কমলাপুর, কাকরাইল ও গুলশানে। গুলশানের নিকেতনের বিলাসবহুল বাড়িতেই বেশি সময় কাটাতেন শামীম। তার অফিস হিসেবে ব্যবহৃত বাড়ির তৃতীয় তলায় রয়েছে শামীমের বসার কক্ষ। বাড়িটি সাজানোর জন্য চায়না থেকে বিভিন্ন ধরণের ল্যাম্প আনেন। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ ফুট চওড়া কক্ষটিতে প্রায় রাতেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতেন। কখনও কখনও নামিদামি মডেল, নায়িকারা ভিড় করতেন তার এখানে। এছাড়া দেশের বাইরেই বেশি থাকতেন তিনি। নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে বেশি আসা-যাওয়া করতেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠরা জানান, মালয়েশিয়া ও নেপালে ব্যবসা রয়েছে তার।

তবে সাত আট বছর আগেও শামীমের আড্ডা ছিলো বাসাবো এলাকায়। ওই সময় থেকেই বিভিন্ন ক্লাবে জুয়ার আসরে রাত কাটাতেন তিনি। ঘুমাতেন দিনভর। এমনকি ঢাকার আশপাশে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকায় জুয়ার আয়োজন করতো তার লোকজন। প্রশাসন ম্যানেজ থেকে শুরু করে আর্থিক কাজগুলো করতেন তিনি। জি কে শামীমের আরেকটি সিন্ডিকেট রয়েছে যারা ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করে নিয়মিত। স্থানীয় যুবলীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে এসব অপকর্ম করতেন শামীম। এমনকি মাদক ব্যবসায়ীরাও মাসোহারা দিতো তাদের। ঠিকাদার হিসেবে তিনি গণপূর্ত ভবনের কাজ বাগিয়ে নেন সহজেই। এই চক্রে রয়েছে প্রভাবশালী বেশ কয়েক যুবলীগ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা। অন্য ঠিকাদারদের মুখ বন্ধ করতে রয়েছে শামীম বাহিনীর অস্ত্র। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঠিকাদার জানান, অনিয়ম করে কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কাজ বাগিয়ে নেয় এই চক্রটি। এ নিয়ে কথা বলার সাহস কারও নেই। সন্ত্রাসী ও অস্ত্র সবই তাদের। অস্ত্র ও সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া চলাফেরা করেন না শামীম। গত ১০ বছর যাবত দামি দামি গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। বাসা থেকে বের হলেই নিরাপত্তা বলয়ে থাকেন তিনি। জি কে শামীমের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি জানান, সন্ধ্যার পর চাঁদাবাজি ও জুয়ার আসরের টাকা বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হতো কাকরাইলে। সেখানে তাদের এক নেতার অফিসে ভাগ বাটোয়ারা হতো এসব টাকার। ওই অফিসে ঢাকা দক্ষিণ এলাকার আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হাজির হতেন।

জি কে শামীমের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামে। তার পিতা মৃত মো. আফসার উদ্দিন। তিনি ছিলেন শিক্ষক। তবে কৈশোর থেকেই শামীম থাকতেন ঢাকায়। সুবিধাবাদী হিসেবে পরিচিত শামীম গত বিএনপি সরকারের আমলে যুবদলের রাজনীতি করতেন। ক্ষমতার পালা বদলে মিশে যান যুবলীগের সঙ্গে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status