প্রথম পাতা

মানবজমিনকে শীর্ষেন্দু

এনআরসি’র নামে আসামে যা হচ্ছে তা বিপজ্জনক

কাজল ঘোষ

১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

আসামের নাগরিক তালিকা বা এনআরসি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। বলেছেন, এনআরসি’র নামে আসামে যা হচ্ছে তা বিপজ্জনক। সরকার যেভাবে তাড়াতে চাইছে এটা সম্ভব নয়। শুধু এনআরসি নয়। খ্যাতনামা এই লেখক কথা বলেছেন তাঁর লেখালেখি, প্রেম, ভালোবাসা, চোর, ভূত প্রীতি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর লেখক হওয়া নিয়ে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শেকড় এদেশেই। টান অনুভব করেন জন্মভিটের জন্য।

বলেন, অনেক আগেই দেশ হারিয়ে গেছে। আমি এ দেশের লোক নই ভাবতে আমার কষ্ট হয়। আমার আইডেন্টিটি হারিয়ে গেছে। কিন্তু টানটা রয়ে গেছে। রাজনীতির কারণে যে দেশভাগ তার ফল আজও বইতে হচ্ছে। এ দেশে যতদিন ছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি আছি সেই দেশে। দ্যাটস নট এ হোম, জাস্ট হোম। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। শরতের সকালে এক চিলতে রোদ মাথায় নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রশস্ত লাল দালানের উঁচুতলায় বাতিঘরে বসে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।

ছেলেবেলায় ময়মনসিংহের সময়কাল মনে করে খ্যাতনামা এই লেখক বলেন, এটা আমার জন্মভূমি। দেশভাগের বাস্তবতায় আজ ওপারে। তবুও পরিযায়ী পাখির মতো আমি এখানে ছুটে আসি। নিজের লেখক সত্তা নিয়ে নিজেরই প্রশ্ন। শীর্ষেন্দু মনে করেন, তিনি বাই চান্স লেখক। বলেন, লেখক হবো এমন চিন্তা মাথায় নিয়ে লিখেছি বিষয়টি তা নয়। আমি আসলে বাই চান্স লেখক। প্রথাগত লেখক সংজ্ঞার মধ্যে আমি পড়ি না।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর ময়মনসিংহে। পিতা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। ছেলেবেলা কেটেছে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বিভিন্ন অংশে। প্রথম চাকরি স্কুলশিক্ষক হিসেবে। পরে আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। যৌবনে ভয়ানকভাবে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন, জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং একসময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত মা-বাবা তাঁকে শ্রী শ্রী অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের কাছে নিয়ে যান। ঠাকুরের সান্নিধ্যে জীবন বদলে যায় মানুষটির।

নিজের লেখা প্রথম দুটি গল্প ফেরত এসেছিল দেশ পত্রিকার দপ্তর থেকে। তৃতীয়টি পাঠানোর পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদি এটি ছাপা না হয়, তাহলে লেখালেখিই ছেড়ে দেবেন। ‘জলতরঙ্গ’ নামে সেই তৃতীয় গল্পটিই ছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ছাপা হওয়া প্রথম লেখা। প্রথম উপন্যাস ঘুণপোকা লিখেছিলেন সাগরময় ঘোষের তাগাদায়। ঘুণপোকার শ্যামল চরিত্রটি অনেকটা তাঁর নিজের আদলেই গড়া।

আশি বছরের ঊর্ধ্ব এই লেখকের জীবনবোধ, সাহিত্য চর্চা, লেখক হওয়া, নানা বিশ্বাসে বন্দি জীবন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। পাঠকের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন ঢাকার বাতিঘরে। পাঠক আর লেখকের মেলবন্ধনে সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন বাতিঘর প্রধান দীপঙ্কর দাশ।

শীর্ষেন্দু বলেন, ছেলেবেলায় দুরন্ত ছিলাম। এতটাই দুরন্ত যে, আমার ডাক নাম হয়ে গেল দুষ্টুর সমার্থক। পাড়ার সকলে রুনু নামে ডাকতো। পাড়ায় কোনো দুষ্টু ছেলেমেয়ে দেখলে বলতো এটা রুনুর মতো হয়েছে। খেলাধুলা ছিল আমার পছন্দের বিষয়। আর বই পড়ার অভ্যেস ছিল। হাতের কাছে যা পেতাম তাই পড়তাম।
জীবনে প্রেম করতে পারিনি। কোনো প্রেমিকা ছিল না। আমার প্রেমগুলো ছিল একতরফা। একতরফা অনেককেই ভালোবেসেছিলাম। পরে একজনই আমাকে ভালোবেসেছিল। যাকে পেয়ে যাওয়ায় আর কাউকে খুঁজতে হয়নি।

ভারত সরকার এনআরসি’র নামে আসামে যা করতে চাইছে তা বিপজ্জনক। সরকার যেভাবে তাড়াতে চাইছে সেটা সম্ভব নয়। এতগুলো লোককে এভাবে তাড়ানো সম্ভব- এটা মনে হয় না। যদিও পশ্চিমবঙ্গের চিত্র ভিন্ন। সেখানে ব্যবসায়িক, চাকরিসহ নানা কারণে বহু ধরনের লোকের বাস। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

বাংলা ভাষা কি সংকটে আছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলা হচ্ছে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। ভাবুন তো যদি এর সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত হতো; বাংলাদেশ যদি আলাদা রাষ্ট্র না হতো তাহলে বাংলা হতো পুরো ভারতের বৃহত্তম রাষ্ট্রভাষা। কাজেই সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি তাতে বাংলা ভাষা কোনো ধরনের হুমকিতে আছে বলে আমার কাছে তা মনে হয় না।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অনেক লেখায় চোরদের প্রতি মমতার প্রকাশ রয়েছে। আবার ভূতদেরও তিনি তাঁর লেখায় এঁকেছেন মানবিকভাবে। বিজ্ঞানমনস্কতার এ যুগে এগুলো একধরনের রহস্যের জন্ম দেয়। শীর্ষেন্দুর সোজাসাপ্টা জবাব, চোরদের নিয়ে আমি নির্মম হতে পারি না। মনে হয়, চোর আমার বাসায় এলে তাকে কাছে বসিয়ে দু’চারটি কথা বলি। ভূত বিষয়ক অনেক লেখা পড়ে বাচ্চারা আমাকে ফোন করে বলে যে, সে আর ভূতকে ভয় পাচ্ছে না। তখন আমার ভালো লাগে। মনে হয়, যাক লেখাটি মনে ধরেছে।

প্রসঙ্গ যখন বাংলাদেশ

বাংলাদেশে এলে একটি বিষয় ভালো লাগে, তা হলো এখানে পাঠক বেড়েছে। একবার কোথাও যাচ্ছি লঞ্চে করে। হঠাৎ একটি ছেলে আমার বই নিয়ে এসে অটোগ্রাফ চাইলো। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তুমি এখানে বই পেলে কোথায়? বললো, লঞ্চের মধ্যেই আপনার বই বিক্রি হচ্ছে। বিস্মিত হয়েছিলাম। এখন সময় বদলেছে। একসময় বাংলাদেশ থেকে অনেক টাকা রয়্যালটি পেতাম। এখন তা কমছে। কারণ বই অনেক বেশি পাইরেসি হচ্ছে। ফলে আগের মতো রয়্যালটি পাই না।

লেখালেখির জগৎ

বই পড়তে পড়তেই একসময় ইচ্ছে জাগলো লিখতে পারি কিনা? ধীরে ধীরে গল্প, কবিতা এসবের চর্চা শুরু করি। প্রথমদিকে এসব লেখা কোথাও ছাপা হতো না। ষোল সতেরো বছর বয়স। খুব বিক্ষিপ্ত জীবন কেটেছে। আমাকে পড়াশুনার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হলো কুচবিহার। সেখানকার হোস্টেলে লম্বা সময় কেটেছে। এ সময় পরিবারের সঙ্গে তৈরি হয়েছে বিচ্ছিন্নতা। তখন থেকেই মাথায় লেখার ভূত চাপে। ১৯৬৭ সালের কথা। সে সময় দেশ পত্রিকায় একটি গল্প ছাপা হলো। প্রথম উপন্যাস বের হলো-ঘুণপোকা। তখন আমার লেখার পাঠক ছিল না। খুব কষ্ট পেতাম। এত কষ্ট করে লিখি কিন্তু পাঠক পড়ে না কেন? পাঠক আমার লেখা প্রত্যাখ্যান করে কেন? একবার প্রচার হয়েছিল একটি ছেলে সতেরবার ঘুণপোকা বইটি পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভাগ্য ভালো, দীর্ঘদিন পর আমার সেই লেখাগুলোই এ প্রজন্মের পাঠকরা গ্রহণ করেছে। পড়তে শুরু করেছে। কপাল ভালো এখনকার পাঠক আমার লেখা বুঝতে পারে, এটাই আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি। পাঠকরা যখন আমার লেখা সাদরে গ্রহণ করতে শুরু করলো তখন মনে হলো আমি যেন কবর থেকে ওঠে এলাম।

নিজ আয়নায়

আমি আসলে অবৈজ্ঞানিক বা আনসায়েন্টিফিক লেখক। আমি আমার লেখার কথা নিজেই ভুলে যাই। হঠাৎ কোনো চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করলে সে বিষয়ে বলতে পারবো না। কারণ, যে লেখা বেরিয়েছে তা হয়তো আর পড়া হয়ে ওঠেনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে হয়তো কোনো মারামারির দৃশ্য দেখছি কিছু না বুঝেই। নিজের পরিচয় দিতে আমি বরাবরই লজ্জাবোধ করি। আশেপাশের ভিড় থেকে কেউ এগিয়ে এসে হয়তো আমাকে বললো, আপনাকে দেখতে অনেকটা শীর্ষেন্দুর মতো মনে হচ্ছে। আমি লজ্জাবনত হয়ে বলি, লোকে তাই বলে। আমার লেখালেখি হাতে দলা পাকিয়ে সুতো কাটার মতো। একটি লাইন থেকেই আমার উপন্যাসের জন্ম। যেভাবে একটি দলা পাকাতে পাকাতে তা থেকে সুতো বের হয়। ঠিক তেমনি কোনো একটি লাইন আমি পেয়ে গেলে তা থেকেই বড় উপন্যাসের জন্ম। আমার মনে হয় উপন্যাসের চরিত্রগুলো আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। মনে হয়, আমি নিজে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করিনি, ওরাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে। উপন্যাসে বাস্তবতাকে যেভাবে আঁকা যায় ছোট লেখায় তা হয় না।

সভ্যতার বর্তমান সংকট
পৃথিবীর অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে দিনকে দিন। পৃথিবী ধীর ধীরে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বা প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। আমার মনে হয়, পৃথিবীর ধ্বংস খুব বেশি দূরে নয়। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় কিনা এটাই দেখার বিষয়। এই যে আমাজন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে আগুন লাগেনি; আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাও করা হয়েছে ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে। সেখানে পৃথিবীর বড় বড় কেম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগ চিন্তা নিয়ে এগুচ্ছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো মানতেই চাইছেন না জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির কথা। কাজেই উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সংকট বাড়ছে। চারদিকে কেবল দালান ওঠছে। কৃষিজমি কমছে। পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বন্ধের জন্য যে ধরনের কাজ করা দরকার বড় দেশগুলো তা নিয়ে ভাবছে না। উল্টো তারা এ সমস্যায় আরো জল ঢেলে দিচ্ছে।

প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

ষোল সতেরো বছর বয়সেই মনে হয়েছিল কিছু করতে পারবো না। লেখালেখি করে জীবন কাটাবো। লেখার শুরুটা ছিল প্রত্যাখ্যানের। আমি লিখে খ্যাতি, পুরস্কার, অর্থ উপার্জন করতে চাইনি। চেয়েছি শুধু সাড়া মিলুক। নিজেকে সেলিব্রেটি ভাবতে অভ্যস্ত নই। সাদামাটা জীবন যাপন করি। বারবার যা চেয়েছি তা হলো, আমার লেখার তরঙ্গ যেন পাঠকের অন্তরকে স্পর্শ করে। যেকোনো বিশ্বাস আত্মীকরণ না হলে; অন্তয না হলে তা সুইসাইডাল হয়। আর একটি কথা, পাঠকের সঙ্গে আপস নয়। আমার লেখা আমি লিখবো। তা পাঠক নেবে কিনা সেটা সময় বলবে। কিন্তু পাঠকের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করলে লেখক হওয়া যাবে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status