দেশ বিদেশ

আগুনে কি ইরানই ঘি ঢালছে?

অনিম আরাফাত

১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:১৪ পূর্বাহ্ন

আরামকো’র দুটি তেলক্ষেত্রে ভয়াবহ ড্রোন হামলাকে বলা হচ্ছে সৌদি আরবের অভ্যন্তরে হওয়া ইতিহাসের সব থেকে বড় হামলাগুলোর একটি। এতে দেশটি যে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে তা ক্রমাগত সপষ্ট হতে শুরু করেছে। একদিনেই সৌদি আরবের তেল উৎপাদন মাত্রা অর্ধেকে নেমে এসেছে। যে তেলক্ষেত্রে হামলা হয়েছে সেটি শুধু সৌদি আরব নয়, সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সব থেকে বড় তেল উৎপাদন কেন্দ্র। আর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এতটাই গুরুতর যে সেখান থেকে পুনরায় তেল উৎপাদন স্বাভাবিক করতে দেশটির কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। ইতিমধ্যে ১৯৯১ সালের পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। হামলার পর একদিনেই লাফিয়ে ২০ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে তেলের। কিন্তু এখনো সপষ্ট নয় এত বড় একটি হামলার পর সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া ঠিক কী হতে চলেছে!
শনিবারের ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে ইয়েমেনের ইরানপন্থি সংগঠন হুতি। সশস্ত্র ওই সংগঠনটির বিরুদ্ধে গত ৪ বছর ধরে ইয়েমেনে যুদ্ধ করছে সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোট। দীর্ঘ এ সময় হুতিরা বারবার নিজেদের সামর্থ্য দিয়ে সৌদির শাসকদের বুকে ভয় ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে। তবে এ বছরের আগপর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা তারা পায়নি। কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে প্রায়শই তারা সৌদি আরবের অভ্যন্তরে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা টার্গেট করে হামলা পরিচালনা করছে। সপষ্টতই তাদের সক্ষমতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগঠনটির দাবি, ইয়েমেনের সাধারণ মানুষের ওপর সৌদি আরবের নির্বিচারে বোমাবর্ষণের জবাবের অংশ হিসেবেই শনিবারের ওই ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে।
হুতির দাবি অনুযায়ী, দশটি বোমাবাহী ড্রোনের মাধ্যমে ওই হামলা পরিচালনা করা হয়। কিন্তু এ দাবি ইতিমধ্যে প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি সপষ্টভাবেই বলছে, এ হামলার পেছনে সরাসরি ইরানের হাত রয়েছে। হুতির মতো সংগঠনের পক্ষে এ ধরনের হামলা চালানো সম্ভব নয়। হুতির দাবি, এ হামলা চালাতে তাদেরকে সাহায্য করেছে সৌদি আরবের মানুষই। তবে এ দাবিকে অসম্ভবই মনে করা হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে। অন্য যেটি হতে পারে তা হলো, অন্যান্যবারের মতো ইয়েমেনের হুতি নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে হামলা পরিচালনা করা হয়েছে। এ জন্য তাদেরকে প্রায় ১ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যে নির্ভুল হামলা চালাতে হয়েছে। সৌদির এত অভ্যন্তরে হুতির এই মাত্রার হামলার সামর্থ্য রয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সত্যিকার অর্থে হুতির এ হামলার পেছনে জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশ কম। ইরানের সহযোগিতায় ড্রোন প্রযুক্তিতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করা সত্যেও এত বড় পাল্লায় নির্ভুল হামলা হুতিরা চালাতে পারে না। সব থেকে বড় কথা হলো, হুতিকে হামলা চালাতে হলে সৌদি আরবের আধুনিকতম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পার হয়ে ওই হামলা চালাতে হবে। ফলে সন্দেহ জোরালো হচ্ছে যে, ইরাকের দক্ষিণাঞ্চল থেকেই এ হামলা পরিচালিত হয়েছে। এটি হামলার শিকার তেলক্ষেত্রগুলো থেকে বেশ কাছেই। ইরাকের সামরিক বাহিনী পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্স বা পিএমএফ ইরান সরকারসমর্থিত। এটি সৌদি সীমান্ত এলাকায় বেশি সক্রিয় থাকে। সমপ্রতি ওই অঞ্চলে থাকা ইরানি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিলো ইসরাইল। ধারণা করা হচ্ছে সেখান থেকেই শনিবারের হামলা চালানো হয়েছে। এ বছরের মে মাসে সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থানে ড্রোন হামলা শুরু হয়। হামলার পর এর দায় স্বীকার করে নেয় হুতি যোদ্ধারা। কিন্তু গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, এসব হামলা ইয়েমেন থেকে নয় বরং ইরাক থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এবং এসব হামলা চালাচ্ছে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ইরাকের ইরানপন্থি সামরিক বাহিনী। এ ছাড়া যেসব ড্রোন থেকে শনিবারের হামলাটি চালানো হয়েছে তা পরীক্ষার পর এ দাবি আরো জোরালো হয়েছে। এমন আধুনিক মানের ড্রোন ও বিস্ফোরক একটি বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে থাকা অসম্ভব বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। হামলার একদিন পর রোববার মিডল ইস্ট আইকে ইরাকের একজন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ইরাকের অভ্যন্তর থেকেই ওই হামলা পরিচালনা করা হয়েছিলো। তবে ওই কর্মকর্তা নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি। নেদারল্যান্ডসের যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ আরউইন ফন ভিন বলেন, হুতি হোক বা যেই হোক না কেনো এ হামলার সঙ্গে ইরান জড়িত ছিলই। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি কর্তৃপক্ষও দাবি করে আসছে, ইরানের রেভ্যুলুশনারি বাহিনী সৌদির আরামকো’র তেলক্ষেত্রগুলোকে টার্গেট করে ক্রুজ মিসাইল হামলার পরিকল্পনা করছে। আর এ হামলা তারা ইরাকের অভ্যন্তর থেকে পরিচালনা করতে চলেছে বলেও আশংকা করেছিলেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। ইতিহাসজুড়ে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ছিল বৈরী সমপর্ক। গত কয়েক বছরেও দেখা গেছে তার প্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যে দু’দেশের মধ্যেকার বৈরী ভাব প্রক্সি যুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে আগুন জ্বলছে সামপ্রতিক সময়ে তাতে ঘি ঢালতে শুরু করেছে ইরান। আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও তার পশ্চিমা মিত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে দেশটি। গত শনিবার সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলায় ইরানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা তারই অংশ। ফলে ওই আগুন থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ মাত্রার যুদ্ধের আশংকা ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status