বাংলারজমিন
হাওর তীরে জমজমাট পোনামাছের রাতের হাট
ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ৭:২৮ পূর্বাহ্ন
এই হাটগুলো শুধু রাতেই জমজমাট। হাওর তীরের পোনামাছের হাট। সংশ্লিষ্টদের কাছে এক নামেই এমন পরিচিতি। এই হাটগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো গোপনীয়তায় ক্রেতা-বিক্রেতার সমঝোতার ভিত্তিতে দ্রুত সম্পন্ন হয় বেচাকেনা। আর গাড়িযোগে তা দ্রুত পৌঁছানো হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিনই রাতের আঁধারে হয় পোনামাছ ধরা আর কেনাবেচা। মৌসুমে পুরো হাওরজুড়ে চলে এমন রমরমা ব্যবসা। এখন মৌসুম শেষ পর্যায়ে হলেও থেমে নেই পাচারকারীদের এমন দৌরাত্ম্য। এ তথ্য স্থানীয় বাসিন্দাদের। প্রতিদিনই প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কর্মকাণ্ড চললেও সংশ্লিষ্টরা রহস্যজনক কারণে রয়েছেন নির্বিকার। এশিয়ার অন্যতম ও দেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে এখনো অবাধে চলছে দেশীয় প্রজাতির পোনামাছ নিধন। প্রতিদিনই অবাধে পোনামাছ নিধনের কারণে দেশের মিঠাপানির মৎস্য ভাণ্ডারখ্যাত হাকালুকির মৎস্যসম্পদ এখন হুমকির মুখে। গেল ক’বছর থেকে বন্যা আর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে এমনিতে বির্পযস্ত হাওর। আর ২০১৭ সালের আকস্মিক বন্যায় দেশীয় প্রজাতির মাছ মড়কে চলছে মাছের আকাল। পোনামাছ নিধনকারী চক্রের কারণে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে হাকালুকি হাওরের দেশীয় প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। জানা যায়, প্রশাসনের নীরবতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় স্থানীয় অসাধু মৎস্য ব্যবসায়ীদের সহায়তায় পাচারকারীরা প্রতিদিনই পুরো হাওর থেকে দুই থেকে তিন টন পোনামাছ পাচার করে বিক্রি করছে দেশের বিভিন্ন বাজারে। দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এখনো অনেকটা ভরপুর হাকালুকির সবক’টি জলমহাল। এ সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন স্থানীয় দরিদ্র মৎস্যজীবীদের দিয়ে হাওরে বেড়জাল, কারেন্ট জাল ও কাপড়ি জালের মাধ্যমে মাছ শিকার করেন। এসব জালে আটকা পড়ছে বিভিন্ন জাতের দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা। হাকালুকি হাওর থেকে পোনামাছ শিকার করে রাত ১০টা থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত কুলাউড়া উপজেলার ভূকশীমইলের নবাবগঞ্জ বাজার, তেঘরী ঘাট ও জুড়ী উপজেলার আশুরিঘাট, মানুসিং (কাটানালির পাড়) ও কন্টিনালা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় শিকারিরা তা বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। তাছাড়া বড়লেখা ও ফেঞ্চুগঞ্জ অংশে বেশ ক’টি স্পট দিয়ে রাতের আঁধারে অথবা ভোর বেলা চলে এই পোনামাছ কেনা বেচা। স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের নির্দিষ্ট বিভিন্ন বড় বড় শহরের পাইকারদের কাছে নিলামে বিক্রি করেন। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ধরা ও বিক্রিনিষিদ্ধ এসব পোনামাছ ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে যান সিলেট, হবিগঞ্জ ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে। বছরের ৫ মাস ২৩ সেন্টিমিটারের (৯ ইঞ্চি) চেয়ে কম মাপের শোল, রুই, কাতলা, মৃগেল, কালীবাউশ আইড় এবং বোয়ালসহ সব ধরনের পোনামাছ ধরা ও বিক্রি এবং বেড়জালসহ ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটারের কম ব্যাসার্ধের ফাঁকবিশিষ্ট জাল ব্যবহার সম্পূর্ণ আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু এ সময় জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় ও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীরা তাদের দিয়ে মা মাছের পর পোনামাছ শিকার করান। এমনটিই জানালেন হাওরতীরবর্তী কুলাউড়া উপজেলার সাদিপুর, মিরশংকর ও জুড়ী উপজেলার বেলাগাঁও ও শাহপুরের মৎস্যজীবী লোকজন। হাওরতীরবর্তী বাসিন্দারা জানান, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের আঁতাতে বর্ষাকালে প্রতিদিন রাত ৯টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত কুলাউড়ার নবাবগঞ্জ বাজার, তেঘরীঘাট ও জুড়ীর মানুসিংহ বাজার, কন্টিনালা নদীর ব্রিজসংলগ্ন পাড়ে ‘রাতের হাট’ বসে। হাকালুকি থেকে শিকারিরা পোনামাছ নিয়ে আসেন এই হাটে। ওই হাটগুলোতে নির্দিষ্ট পাইকারদের কাছে দ্রুত বিক্রি হয় মাছ। পাচারকারী ও ব্যবসায়ীরা স্থানীয় প্রভাবশালীদের লোক হওয়ায় কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ বলেন আমরা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে পোনা মাছ ও জাল জব্দ এবং জরিমানা করেছি। গভীর রাতে অভিযান পারিচালনা করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও পোনামাছ নিধনে সক্রিয় পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইননানূগ ব্যাবস্থা নেয়া হবে। ইতিমধ্যে আমরা কয়েকটি অভিযানও চালিয়েছি। আমাদের এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে।