বিশ্বজমিন

রোহিঙ্গা হলো এশিয়ান সঙ্কট

বেট্রিস লাউ

১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১:২১ পূর্বাহ্ন

দুই বছর হয়ে গেছে। কয়েক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ শরণার্থী সঙ্কট সমাধানের ধারেকাছেও যেতে পারেনি এশিয়া। শুধু বাংলাদেশে অবস্থান করছেন কমপক্ষে ৯ লাখ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে রয়েছেন ২০১৭ সালের আগস্টে শুরু হওয়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে পালিয়ে আসা ৭ লাখ ৫৯ হাজার। এর আগেভাগে সহিংসতাগুলো থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে গিয়েছেন ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত এবং এখানে ওখানে। এটা হলো একটি এশিয়ান সঙ্কট। কিন্তু এক্ষেত্রে শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রদর্শন করতে হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে।

এ মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে এবং নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় এসাসিয়েশন অব সাউথ-ইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) সামিটে একত্রিত হবেন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নেতারা। ২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বা কথা বলার ক্ষেত্রে যা দু’চারটি মাধ্যম সক্ষমতা অর্জন করেছে, তার অন্যতম আসিয়ান। রোহিঙ্গাদের প্রতি আঞ্চলিক নেতাদেরকে অবশ্যই সমবেদনা দেখাতে হবে এবং সহিংসতা, বৈষম্য এবং নিষ্পেষণ বন্ধে মিয়ানমারকে চাপ দিতে হবে, যার জন্য রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। যদি তা না হয়, তাহলে এই ট্রাজেডি অব্যাবহতভাবে চলতেই থাকবে।

মালয়েশিয়া, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসা বিষয়ক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন মেডিসিন সান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ)। এটা করতে গিয়ে এই সংগঠন প্রত্যক্ষ করেছে, রোহিঙ্গারা প্রতিদিন কিভাবে লড়াই করছেন। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়াতে রোহিঙ্গাদের শরণার্থীর মর্যাদা নেই। তাদের প্রয়োজন অস্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য আইনগত বৈধতা। মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করে, তাদেরকে দেখা হয় বিদেশী হিসেবে। রোহিঙ্গাদের এই বিপন্ন অবস্থার মূল কারণ হলো তারা রাষ্ট্রহীন।

মালয়েশিয়াতে কাজ করতে গিয়ে খারাপভাবে আহত রোহিঙ্গা রোগিদের চিকিৎসা সেবা দেয় এমএসএফ। এসব রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে সরকারি হাসপাতালে যান না। এর কারণ হলো ইমিগ্রেশনে তাদেরকে নিয়ে রিপোর্ট হওয়ার ভয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, কর্মশক্তিতে বৈধভাবে শরণার্থীরা যুক্ত হওয়ার ফলে সেখানে লাখ লাখ রিঙিত যোগ হতে পারে জাতীয় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে। আসতে পারে বড় অংকের আয়কর। একই সঙ্গে সৃষ্টি হতে পারে মালয়েশিয়ার নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান। পাকাতান হারাপান পার্টি তার নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে শরণার্থীদের আইনগত মর্যাদা ও কাজ করার অধিকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা উচিত সরকারের। রোহিঙ্গাদেরকে অস্থায়ী মর্যাদা থেকে দেশে বৈধভাবে কাজ করার মর্যাদা দিয়ে তাদের মর্যাদার প্রশ্নে একটি উদাহরণ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিতে পারে মালয়েশিয়া।

এমএসএফ টিম দেখতে পেয়েছে বাংলাদেশে কিভাবে গাদাগাদি করে আশ্রয় শিবিরগুলোতে অবস্থান করছে রোহিঙ্গারা। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা কাজের মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অক্ষম। বাংলাদেশের উদারতা পাতলা হয়ে আসছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে শরণার্থীরা ক্রমবর্ধমান হারে তাদের অধিকার খর্ব করে দেয়ার মুখোমুখি হচ্ছেন। চলাচলে বিধিনিষেধ থাকার কারণে স্বাধীনভাবে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সামনে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। মানসিক সমস্যা, যৌনতা ও লিঙ্গগত সহিংসতার জন্য বিশেষায়িত সেবার ঘাটতি রয়েছে। কক্সবাজারে তাদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র মাধ্যম হলো এমএসএফের মতো মানবিক সেবাদানকারী অনুমোদিত সংস্থাগুলো।

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা এমএসএফ’কে বলেছেন, তারা মনে করেন তাদেরকে থামিয়ে রাখা হয়েছে। নিত্যদিন তারা শুধু বেঁচে থাকার বাইরে যেতে পারছেন না, তাদের পরিচয়ের কারণে। তারা বলছেন, যখন তারা দেশে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তখন তারা বর্তমানে নিজ দেশে উন্নত জীবনের কোনো পথই দেখতে পাচ্ছেন না। মিয়ানমারে পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সেখানে সেনাবাহিনী ও রাখাইন উগ্রপন্থি গ্রুপ আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াই চলছে। এতে কয়েক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সর্বশেষ এই সহিংসতায় সব সম্প্রদায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মধ্য ও উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইনজুড়ে মানবকি সহায়তার ওপর বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে। চলছে কারফিউ।

উপরন্তু, রাখাইন রাজ্যে এখনও অবস্থান করছেন সাড়ে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ রোহিঙ্গা। তারা চলাচলের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক বিধিনিষেধ সহ্য করছেন। স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে এতে তাদের সক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে, চিকিৎসা সেবা নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য খুব ব্যয়বহুল ও বড় রকম বিপদের কথা। কারণ, এক্ষেত্রে তাদেরকে হাসপাতালে যাওয়ার পথে পুলিশ চেকপোস্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ জন্য তাদের প্রয়োজন হয় কাগজপত্র । দিতে হয় ঘুষ।

২০১২ সালের ভয়াবহ সহিংসতার পর রাখাইনের মধ্যাঞ্চলের রোহিঙ্গা ও মুসলিমদের অন্য একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কামান-এর কমপক্ষে ১ লাখ ২৮ হাজার সদস্য কার্যত বন্দি এবং সাত বছর ধরে বাস্তুচ্যুত হয়ে তারা শিবিরে আটক দিন কাটাচ্ছেন। নিজেদের ইচ্ছায় স্বাস্থ্যসেবার জন্য চলাচল করতে পারেন না রোহিঙ্গারা। তাদেরকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে এমএসএফের প্রয়োজন হয় পুলিশি প্রহরা। হাসপাতালে নেয়ার পর তাদেরকে বিচ্ছিন্ন একটি ওয়ার্ডে রাখা হয়।

ওদিকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সরকারের প্রস্তুতিতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আসিয়ানের কো-অডিনেটিং সেন্টার ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসিসট্যান্স অন ডিজঅ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট (এএইচএ)। যদিও এএইচএ রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি, তবু এটা একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। এর ফলে জুনে এএইচএ যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে মাঠপর্যায়ের বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়নি, যেমন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ সুবিধা।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন রাখাইন এডভাইজরি কমিশন যেসব সুপারিশ করেছিল তা বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে সমর্থন দেয়া উচিত আসিয়ানের। এর খসড়ায় যেসব কথা বলা হয়েছিল, তার যদি পূর্ণাঙ্গতা অনুধাবন করা যায় তাহলে সব সম্প্রদায় উপকৃত হবে।

মিয়ানমারের ভিতরে অবস্থানকারী এবং পালিয়ে যাওয়াসহ সব রোহিঙ্গার কাছে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হওয়া দরকার। তা হলো তাদের নাগরিকত্বের অধিকার। জন্ম নিবন্ধনের মতো ইস্যুগুলোতে একটি টেকনিক্যাল পর্যায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আসিয়ান। পাশাপাশি নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়ার জন্য তাকে চাপে রাখতে পারে।

এ জন্য মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বিস্তৃতভাবে আলোচনা প্রয়োজন আসিয়ানের। সদস্য রাষ্ট্রগুলো এসব আলোচনার মূল অংশ করতে পারে রোহিঙ্গাদের বাদ রাখা ও তাদের প্রতি চালানো বৈষম্যের ইস্যুগুলোকে। আসিয়ানের সামিটে এবং জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের এজেন্ডায় অবশ্যই থাকতে হবে রাখাইন রাজ্য। এসব সামিট বা অধিবেশনে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নেতাদের একসুরে বলা উচিত যে, কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে অঙ্গীভূত করাই হলো এ সমস্যার সমাধান।

(বেট্রিস লাউ মেডিসিনিস সান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ)-এর মালয়েশিয়া মিশনের প্রধান। তার এ লেখাটি ব্যাংকক পোস্ট থেকে অনূদিত)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status