প্রথম পাতা

ভিক্টর বাসের পিষে মারার চেষ্টা

আলভীর মুখে লোমহর্ষক বর্ণনা

শুভ্র দেব

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:০২ পূর্বাহ্ন

ফাঁকা বাস দেখেই ওই বাসে উঠতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম সামনেই তো যাবেন একটু নিয়ে যান। কিন্তু আমার কথা শুনে কোনো উত্তর না দিয়েই চালকের সহকারী গেট বন্ধ করে দেয়। কেন বন্ধ করে দিয়েছে সেটা জানার জন্য বাসের জানালা ধরে উঁকি দিই। আর তখনই চালক আমার দিকে তাকিয়ে বাস স্টার্ট দিয়ে এলোপাতাড়ি টানতে থাকে। তখন চালককে আমি বলেছিলাম ‘বাস থামান, বাস থামান’ আমি যাব না। তারা আমার কথা শুনে নাই। বাস চালাতেই থাকে। আমার পা তখন মাটিতে ছেঁচড়ে যাচ্ছিল। তখন দেখতে পাই সামনে আরেকটি মিনি বাস দাঁড়িয়ে আছে। আমি  তখন অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি বাস থামানোর। নিমিষেই দ্রুত গতিতে গিয়ে আমার শরীর ওই মিনি বাসে ধাক্কা খায়। আমি বুঝতে পারি আমার কোমর ভেঙ্গে গেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে বাসের জানালা থেকে হাত ছেড়ে দিই। শনিবার ভিক্টর পরিবহনের একটি বাস এভাবেই পিষে মারার চেষ্টা করে ইয়ামিন আলভী রবকে। তার বাবা সঙ্গীত পরিচালক পারভেজ রব এ ঘটনার দুদিন আগে ভিক্টর পরিবহনেরই একটি বাস চাপায় মারা যান। সৌভাগ্যক্রমে আলভী বেঁচে গেলেও একই সময়ে ওই বাসের চাপায় প্রাণ হারান তার বন্ধু মেহেদী হাসান ছোটন। বাসের চাপায় গুরুতর আহত আলভী রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে মানবজমিনের কাছে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন তিনি। আলভী বলেন, আমি যখন নিচে পড়ে যাই তখন ছোটনকে ডাকতে থাকি। কিন্তু তার সাড়া শব্দ পাচ্ছিলাম না। পরে অপরিচিত এক লোক এসে আমাকে জানায় ছোটনকেও ওই গাড়ি চাপা দিয়েছে। পরে আরেক বন্ধুকে ফোন দিলে সে এসে আমাদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে জানতে পেরেছি ছোটন মারা গেছে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আলভীর কোমরের চারটি হাড় ভেঙ্গে গেছে। সেরে উঠতে অনেক সময় লাগবে। ততদিন হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে হবে। গতকাল দুুপুরে ট্রমা সেন্টারেই বসে কথা বলার সময় আলভীর মা রুমানা পারভেজ এবং তার সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুায় বোন ইবনাত ও ছিলেন।

আলভী বলেন, বাসা থেকে বাবার কুলখানির বাজার করার একটা লিস্ট আমাকে দেয়া হয়েছিল। কথা ছিল বিকাল বেলা টঙ্গীতে গিয়ে বাজার করে আনার। কিন্তু ভিক্টর পরিবহনের লোকজন ওই দিন বিকালে আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আসার কথা ছিল। বিকাল চারটা থেকে তারা সময় নিতে নিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করিয়েছে। তারপর তারা জানায় ওই দিন তারা আসতে পারবে না। মেহেদী হাসান ছোটন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরে তাকে নিয়েই সেদিন বাবার কুলখানির বাজার করতে উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা করে কামারপাড়া যাই। সেখান থেকে একটি বাসে করে উত্তরার সুইচগেট পর্যন্ত পৌঁছাই। তখন সুইচগেট এলাকায় তীব্র যানজট ছিল। অনেক সময় বাসে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে বাস থেকে নেমে যাই। যানজট পার হয়ে কিছুদূর সামনে গিয়ে ফের বাস খোঁজতে থাকি। কিন্তু প্রত্যেকটি বাসই যাত্রীতে ঠাসা ছিল। এরই মধ্যে একটি ফাঁকা বাস দেখতে পেয়ে  সেটিতে উঠতে চাই। আমি জানতাম না সেটা ভিক্টর পরিবহনের বাস। আগে জানলে ওই বাসে উঠতাম না। ওই চালক সেদিন ইচ্ছে করেই এই কাজ করেছে। চালক আমাকে হয়তো চিনে। কারণ ইস্টওয়েস্ট মেডিকেলের পাশেই আমাদের বাসা। তার পাশেই ভিক্টর বাসের স্ট্যান্ড। ছোটবেলা থেকে ওই এলাকায় বড় হয়েছি। তাই সবসময় তারা আমাকে দেখেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি সেটা তারা শুনেছে। মনে করেছে আমাকে হত্যা করে দিলে তাদের আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

আলভীর মা রুমানা পারভেজ বলেন, আমি শনিবার দুপুরে থানায় গিয়েছিলাম মামলা করার জন্য। আর অন্যদিকে ছেলে ইয়ামিন আলভি রব তার বাবার কুলখানির বাজার করার জন্য বের হয়েছিল। মামলা শেষ করে আমি সন্ধ্যা সাতটার দিকে আলভীর মোবাইলে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু ফোন রিসিভ করেছে তার আরেক বন্ধু। আমি তাকে বললাম আলভীকে দাও। সে তখন আমাকে বলে আলভী ও মেহেদি এক্সিডেন্ট করেছে। এই কথা শুনার পর আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। স্বামীকে রেখে আসলাম কবরে, তার কুলখানিও করতে পারলাম না অথচ এখন ছেলেও এক্সিডেন্ট করেছে। ভিক্টর বাস ইচ্ছে করেই আমার ছেলেকে মারার উদ্দেশ্যে এমন করেছে। তারা মনে করেছে আমার ছেলে তার বাবাকে পিষে মারার প্রতিবাদ করবে, মামলা করবে। এখন দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে আমি সংসার চালাব কিভাবে। ছেলেমেয়েরা  লেখাপড়া করে। বড় ছেলে ইয়াসিন ইরশাব রব মালয়েশিয়ায় হোটেলে ম্যানেজমেন্টে, অসুস্থ আলভী উত্তরা টাউন কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে এবং মেয়ে ইবনাত কামারপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের লেখাপড়ার জন্য প্রতি মাসে অনেক টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া সংসারের অন্যান্য খরচতো আছেই। আগে সব খরচই আমার স্বামী বহন করতেন। তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। এখন তিনি নেই। আলভীর সুস্থতার জন্য প্রতিদিন অনেক টাকা লাগছে। অন্তত দুই মাস তাকে হাসপাতালে রাখতে হবে। বেড ভাড়া প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ টাকা। এর বাইরে ওষুধসহ অন্যান্য খরচ। আমি শুধু তাকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছি। হাসপাতালের বিল কোথা থেকে দিব সেটা জানি না। কারণ, ঢাকা মেডিকেলে তাকে নেয়া হয়েছিল। সেখানে একটি বেড পর্যন্ত মিলেনি। বারান্দার মধ্যে রাখা হয়েছিল তাকে। তিন ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ছিল পাওয়া যায়নি। এক ব্যাগ ম্যানেজ করে দেয়া হয়েছিল সেটি ম্যাচ করে নাই। শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়েছিল তার। আমার ছেলে আমাকে বলে মা আমাকে কোনো চিকিৎসক আইস্যা দেখে না। আর এভাবে বারান্দায় পড়ে থাকতে ভালো লাগছে না। আমাকে বাঁচাও মা। অন্য কোথাও নিয়ে যাও। পরে তাকে ট্রমা সেন্টারে নিয়ে আসি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status