শেষের পাতা

ডেঙ্গুতে ওদের পরিবারে কান্না

স্টাফ রিপোর্টার

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৮:৫৫ পূর্বাহ্ন

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ৩১শে জুলাই মারা যান পুলিশের উপ-পরিদর্শক কোহিনুর আক্তার। কোহিনুরের ১ বছর ৮ মাস বয়সী শিশুকন্যা জাসিয়া জাফরিন দেয়ালে টাঙানো ছবির ফ্রেমে মা’কে খুঁজে ফেরেন। ওদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বাধীনের পরিবার । ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী অস্মিতার পরিবারে এখন কেবলই শুন্যতা। ছোট্ট রাইয়ান সরকারের মা ছেলের স্কুলের আইডি কার্ড, স্কুল ড্রেস বুকে চেপে কান্না করেন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এক একটি মৃত্যুতে শোকের বোঝা বইছে পরিবার। মৃত পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) উপপরিদর্শক (এসআই) কোহিনুরের স্বামী শেখ জহির রায়হান মানবজমিনকে বলেন, সে চলে যাওয়ার ৪২ দিন পূর্ণ হলো। মারা যাওয়ার ৪০ দিন উপলক্ষে গত শুক্রবার মধ্য বাড্ডার আদর্শ নগরের বাসায় মিলাদ মাহফিল এবং দুঃস্থ-এতিমদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছোট্ট জাসিয়া মায়ের বেডরুমের দেয়ালে টঙ্গানো ছবির ফ্রেমের কাছে গিয়ে মা, মা বলে ডাকে। ওটা জাসিয়ার প্রথম জন্মদিনে তোলা ছবি আমরা বাধিয়ে রেখেছি। ওকে যখন জিজ্ঞেস করি আম্মু কোথায়? তখন ছবিতে দেখিয়ে দেয় ওটা তার আম্মু।

আগে থেকেই ও আমার কাছে থেকে অভ্যস্থ ছিল। কারণ ওর মায়ের রাতে ফিরতে দেরি হলে আমার কাছেই থাকতো। এখনো রাতের বেলা জাসিয়া আমার সঙ্গে ঘুমায়। দিনে আমি ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকি। এসময় সে তার নানু ও দাদির কাছে থাকে। তবে কোহিনুরের অভাব এ জীবনে পূরণ হবার নয়। জীবন থেকে কি হারিয়েছি সেটা কেবল আমিই বুঝি। সারা জীবনের কষ্ট এটা থেকেই যাবে। খুব সুন্দর ছোট্ট একটি সংসার ছিল আমাদের। ওর স্বপ্ন ছিল মেয়েকে চিকিৎসক বা পুলিশের বড় কোনো অফিসার বানাবে। আপাতত সেই স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছি।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী অস্মিতার বাবা আমানত মাওলা টিপু বলেন, বেঁচে আছি কোনো রকম। মেয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে ওর মায়ের শরীরের অবস্থা ভালো না। দুই মেয়ের মধ্যে ও ছিল বড়। দুটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে চলে গেছে। চাকরি উপলক্ষে আমরা সাধারণত আশুগঞ্জে থাকতাম। ওর জন্য শুধুমাত্র ঢাকায় এসেছি আমরা। ঢাকায় যখন ভিকারুননিসায় ভর্তির সুযোগ পেল তখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মার্চ মাসে আমরা ঢাকায় চলে আসি। আর আগস্টে সে চলে গেল। মেয়ে হিসেবে সে খুব শান্ত এবং বাধ্যগত ছিল। ছোট মেয়েটা কিছুটা চঞ্চল। বাবা-মা যেমনটা পছন্দ করে সে তেমনই চলার চেষ্টা করতো। শুধু একটা সমস্যা ছিল সে কম খেত। ভালো গান গাইতো। আশুগঞ্জে থাকতে সে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতায় জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে নিয়মিত পুরস্কার পেত। ওর মা যখন একা থাকে তখনই মেয়ের স্মৃতিগুলো মনে করে কাঁদে। আমরা চারজনই একসঙ্গে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হই। তিনজন আক্রান্ত হওয়ার একদিন পরে সে আক্রান্ত হয়। একদিন আগে পর্যন্ত আমাদের তিনজনের সেবা সে’ই করেছে।

মা হেনা নূরজাহান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার স্বামী আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। মেঘনার পাড়ে আমাদের বাসা ছিল। পার্ক ছিল। বিনোদনের কোনো কমতি ছিল না। স্থানীয় ক্লাবে আবৃতি, গান, চিত্রাঙ্কন সবকিছুতেই সে অংশ নিত। এতো মনোরম পরিবেশ ছেড়ে সেখান থেকে আমরা ঢাকা গেলাম শুধুমাত্র ওর ভিকারুননিসায় পড়ার জন্য। ফেব্রুয়ারি মাসে মেয়ের ক্লাস শুরু হয়েছে। এখন আমরা সেপ্টেম্বরে এসে স্টপ হয়ে গেলাম। কারণ ঢাকায় আমাদের আর কোনো কাজ নেই। মেয়ে আমার মতোই সংস্কৃতি এবং প্রকৃতি প্রেমি ছিল। মেয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে ঘুমাতে পারি না। যখনই ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করি তখনই আমার মেয়েকে দেখতে পাই। ওর স্বপ্ন ছিল একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হবে। লুকিয়ে লুকিয়ে ডিজাইন করতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ফিরোজ কবির স্বাধীনের বড় ভাই মো. ফজলুল করিম বলেন, মেধাবী ভাইটিকে হারিয়ে আমরা আজ নিঃস্ব। নিজে খুব বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। তাই কৃষিকাজ করে ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করিয়েছি। অনেক স্বপ্ন ছিল কিছুদিন পরে ভাই ব্যাংকে চাকরি নেবে। আমাদের সকল কষ্ট দুর হবে। স্বাধীন প্রায়ই বলতো, ভাইয়া আর মাত্র কয়েকটা দিন কষ্ট করো। ব্যাংকে আমার ভালো একটা চাকরি হয়ে গেলে আর তোমাদের কোনো কাজ করতে দিবো না। তোমাকে ছোট্ট একটা ব্যবসা ধরিয়ে দিবো। তুমি ব্যবসা করবে। কোথায় গেল আমার ভাই। আমাদের দুঃখের সংসারে আর সুখ পাখিটার দেখা মিললো না। ছেলেকে হারিয়ে মা-বাবা সারাদিন কান্না করতে থাকে। কৃষি কাজ করে যা আয় হয় তাই দিয়ে কোনো ভাবে সংসারটাকে টিকিয়ে রেখেছি।

১১ বছর ৬ মাস বয়সী রাইয়ান রাজধানীর সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। রাইয়ান সরকারের বাবা এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডের জোনাল সেলস ম্যানেজার মমিন সরকার বলেন, ছেলে মারা যাওয়ার পর প্রথম একমাস ওর মামার বাসায় ছিলাম। ওর মা ছেলের আইডিকার্ড, স্কুল ড্রেস নিয়ে কান্না করে। ওর ব্যবহার্য শার্ট, প্যান্ট, ব্যাট, বল, এসব জিনিসপত্র কাউকে ধরতে দেয় না। সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। রাইয়ানের স্কুলের সহপাঠিদের মায়েরা ফোন দিলে মাঝে মাঝে স্কুলের গেটে যায় ওর মা। কোনো ছেলে শিক্ষার্থী দেখলেই বলে আমার ছেলেটা বেঁচে থাকলে এভাবে স্কুলে যেত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status