বাংলারজমিন

ঘাটাইলে বন্ধ হচ্ছে না বাল্যবিবাহ

এবিএম আতিকুর রহমান, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) থেকে

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ৭:৫৭ পূর্বাহ্ন

অনেক স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে বড় কিছু হবো। বাবা মায়ের স্বপ্নপূরণ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো। বিয়ের মধ্য দিয়ে আমার স্বপ্নের কবর রচনা হয়েছে। কথাগুলো বলার সময় চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল ঘাটাইলের নবম শ্রেণির ছাত্রী মীমের। ক্লাসে বিজ্ঞান শাখায় দুই রোল ছিল তার। অল্প কিছু দিন হলো তার বিয়ে হয়েছে। স্বামী প্রবাসী। যে বয়সে ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন বোনার কথা সে বয়সে মীমের মতো ঘাটাইলের অনেক কিশোরীকে স্বামী-সংসারে নিজেকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে। কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায় বাল্যবিবাহ। চলতি বছরের ৮ মাসে উপজেলায় ৫০৬ জন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। যাদের সবার বয়স ১২-১৪ বছরের মধ্যে। উপজেলায় ৬১টি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৩২টি দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে ৬১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানবজমিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এ বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে মোট ৫০৭ জন শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে। ইউএনও অফিস সূত্রে জানা যায়, এই সময়ের মধ্যে উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে মাত্র ১২টি। ২০১৬ সালে এ উপজেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত উপজেলা ঘোষণা করা হলেও তা রয়েছে শুধু কাগজ-কলমে। অধিকাংশ স্কুল ও মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে যে পরিমাণ ছাত্রী ভর্তি হয় দশম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে যেতে তাদের অর্ধেকের বেশিই ঝরে পড়ে শুধু বাল্যবিবাহের কারণে। উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন রয়েছে। পৌরসভা ও প্রতিটি ইউনিয়নভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে আট মাসে বাল্যবিবাহ সংঘটিত হয়েছে ঘাটাইল পৌরসভায় ১৬টি, দেউলাবাড়ি ইউপিতে ৬১ ঘাটাইল সদর ইউপিতে ২, জামুরিয়া ইউপিতে ৪৫, আনেহলা ইউপিতে ২৬, লোকেরপাড়া ইউপিতে ১৪, দীঘলকান্দি ইউপিতে ৩৩, দিগড় ইউপিতে ৩৭, দেউপাড়া ইউপিতে ২৯, ধলাপাড়া ইউপিতে ৪২, সাগরদীঘি ইউপিতে ৫১, লক্ষীন্দর ইউপিতে ৪২, রসুলপুর ইউপিতে ৪৭, সন্ধানপুর ইউপিতে ২৬ ও সংগ্রামপুর ইউপিতে ৩৬টি। উপজেলা প্রশাসন সূত্রে আরো জানা যায়, আট মাসে বাল্যবিবাহ বন্ধ নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আলোচনা হয়েছে ২৪ বার।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করা হয়েছে মা ও অভিভাবক সমাবেশ। তারপরও থামছে না বাল্যবিবাহ। নিকাহ রেজিস্ট্রেশনে সরকারের পক্ষ থেকে এ
সংক্রান্ত বিষয়ে কাজীদের যে বিধিনিষেধ বা আইন রয়েছে তার বিন্দুমাত্র মানতে দেখা যাচ্ছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক জানান, মেধাবী ও দেখতে সুন্দরী এমন মেয়েগুলোই বেশি বাল্যবিবাহের বলি হচ্ছে। অভিভাবকরা গোপনে এ কাজ সেরে ফেলেন।
অনেক অভিভাবক নিজ বাড়িতে বিয়ের কাজ না করে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। যা আমরা জানতে পারি প্রায় সপ্তাহখানেক পর। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, যেসব শিশু শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে তাদের বড় একটা অংশের স্বামী প্রবাসী। প্রবাস থেকে দু্থতিন মাসের ছুটি নিয়ে এসে বিয়ে করে আবার চলে যায় প্রবাসে। ফলে পারিবারিক কলহ ও পরকীয়ায় জড়িয়ে ভেঙে যাচ্ছে অনেকের সংসার। অনেকেই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে মাসের পর মাস থেকে যাচ্ছে বাবার বাড়িতে। এ বিষয়ে ঘাটাইল সরকারি জিবিজি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ শামছুল আলম মনি বলেন, কোনো ভাবেই বাল্যবিবাহ গ্রহণযোগ্য নয়। সভ্য সমাজে এটা মেনে নেয়া যায় না। আমার মতে আমরা আজও সচেতন হতে পারি নাই। উপজেলা কাজী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের বলেন, আমরা কোনো বাল্যবিবাহের নিকাহ রেজিস্ট্রেশন করি না। জন্মনিবন্ধন দেখে তারপর নিকাহ রেজিস্ট্রেশন করি। এ বিষয়ে ইউএনও মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত বাল্যবিবাহ বন্ধে বিভিন্ন সভা সমাবেশ করে যাচ্ছি। এটি বন্ধ করতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।


   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status