প্রথম পাতা

৬ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

২৬ আগস্ট ২০১৯, সোমবার, ৯:৩৪ পূর্বাহ্ন

জানুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। খেলাপি ঋণ কমাতে অনেক চেষ্টাও হয়েছে। তবে আদতে তা থামানো যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। আর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৩ মাসে নতুন করে খেলাপি ঋণ আরো বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।  অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক দায় এড়াতে পারে না। কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল। সেটি ভালোভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা জানান, ঋণ অবলোপনের সময়সীমা ৫ বছর থেকে কমিয়ে ৩ বছর করা হয়েছে। ঋণ শ্রেণিকরণের সময়সীমায়ও ছাড় দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা করা হয়েছে। আসলে এসব সুবিধা দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণের কোনো উন্নতি হয়নি। কারণ খেলাপি ঋণ আদায় করার ব্যাপারে যে সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত, সেটা আসলে হচ্ছে না। উল্টো ঋণখেলাপিদের ছাড় দিতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রভাবশালীরা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মতোই বেসরকারি ব্যাংকের টাকাও লুটপাট শুরু করেছে। ফলে বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর হয়তো বেসরকারি ব্যাংকগুলোকেও বাজেট থেকে ভর্তুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
গত ছয় মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। এ বিষয়ে গতকাল এক বৈঠকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, এর আগে খেলাপি ঋণ কমানোর এক্সিট প্ল্যান বাস্তবায়ন না হওয়ায় খেলাপি ঋণ কমেনি। তবে সরকারি কার্যক্রম শুরু হলেই খেলাপি ঋণ কমে আসবে।

এছাড়া তিন মাসের সময় দিয়ে সুদের হার কমিয়ে সিংগেল ডিজিটে আনার কথাও বলেন তিনি।
এর আগে জানুয়ারি মাসে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, এখন থেকে আর এক টাকারও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। ওই সময় তিনি বলেন, বৈঠকে বসার আগেই আমার শর্ত ছিল একটা। কোনো কিছু আলাপ করার আগে আমার এক দফা। আজকের পর থেকে খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়তে পারবে না। এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে তাও ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হবে। বৈঠকে উপস্থিত ব্যাংক মালিকদের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আপনারা কীভাবে বন্ধ করবেন, কীভাবে টেককেয়ার করবেন, কীভাবে ম্যানেজ করবেন আপনাদের ব্যাপার। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। তাই বলেছি আজকের পর থেকে খেলাপি ঋণ বাড়বে না ইনশাল্লাহ। এ জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আগের সব রেকর্ড ভেঙে বর্তমানে দেশে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ (জুন-১৯ পর্যন্ত) দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। তবে গত ডিসেম্বর খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। সে সময় এক লাফে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছিল ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। সেই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হলে আরও দেড় হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর গত ১ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
এ সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লেও সরকারি ও বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে। এতে শতকরা হিসাবে সার্বিক ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার কমেছে। মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১১.৮৭ শতাংশ, যা জুনে হয়েছে ১১.৬৯ শতাংশ। প্রতি বছর জুন ও ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমে যায়। শতকরা হারের পাশাপাশি পরিমাণগত হিসাবেও কমে খেলাপি ঋণ; কিন্তু এবার জুন প্রান্তিকে শতকরা হিসাবে খেলাপি ঋণ কমলেও পরিমাণগত হিসাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। পুনঃতফসিলের নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তারপরও যখন খেলাপি ঋণ কমেনি, এতে বোঝা যায়, সুযোগ-সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানো যাবে না। বরং এ ধরনের সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে আশকারা পেয়ে খেলাপিরা আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.৬৯ শতাংশ। এর বাইরে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংকের হিসাবের খাতা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে আরো ৪০ হাজার ১০১ কোটি টাকা। এটি যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা।
আগের প্রান্তিক মার্চ পর্যন্ত অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.৮৭ শতাংশ। ফলে মার্চ থেকে জুন- এ ৩ মাসে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের ১০.৩০ শতাংশ। সে হিসাবে গত ৬ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৮ হাজার ৫১৪ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৭ সালের পুরো সময়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা বা ২৫ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণের সার্বিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। খেলাপি ঋণ বন্ধ করতে হলে বড় বড় ঋণখেলাপি যারা তারা কাদের যোগসাজশে এসব ঋণ নিয়েছে এগুলো চিহ্নিত করে দ্রুতগতিতে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান করতে হবে। এককথায় ব্যাংক খাতে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status