প্রথম পাতা

‘হাত-পা বেঁধে নাইমকে শ্বাসরোধ করে খুন করি’

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

১৮ আগস্ট ২০১৯, রবিবার, ৯:০৩ পূর্বাহ্ন

‘গলায় গামছা প্যাঁচানোর পর চিৎকার শুরু করেছিল নাইম। আশপাশের লোকজন চিৎকার শুনে ফেলার আশঙ্কায় তার মুখেও গামছা গুঁজে দেই। এরপর হাত-পা বেঁধে নাইমকে শ্বাসরোধ করে খুন করি। আর খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে লাশ বস্তায় ভরে লালটিলায় ফেলে দেই।’- সিলেটে কিশোর রিকশাচালক নাইম আহমদকে খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা এভাবেই দেয় দুই ঘাতক বন্ধু। শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তারের পর প্রথমে পুলিশের কাছে এবং গতকাল দুপুরে সিলেট আদালতে তারা খুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সিলেট মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক সাইফুল ইসলাম তাদের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন। এ সময় তারা আদালতে জানায়- ‘খুনের ঘটনার পরও তারা স্বাভাবিক ছিল। তাদের কেউ চিনতে পারবে না- এমন মনোভাব নিয়ে তারা এলাকায় ঘোরাফেরা করে। পরে বাসা থেকেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে।’ সিলেটের ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক নাইমের বয়স বেশি নয়। তার সহপাঠীদেরও বয়স কম। নাইমের বয়স ১৫ বছর। আর তার ঘাতক দুই বন্ধুর বয়সও আঠারো থেকে উনিশের মধ্যে। তিনজনই ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রিকশা চালাতো এক সঙ্গে। এরপর তারা একত্রে বসে আড্ডা দিতো।

ঘাতক পারভেজকে ঢংয়ের ছলে দুলাভাই বলে সম্বোধন করতো নাইম। পুলিশ জানায়- নাইমের মূল বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের আলবান্না এলাকায়। তার পিতা আব্বাস উদ্দিন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে নগরীর বালুচর এলাকার সোনাই মিয়ার কলোনিতে বসবাস করছে। ঘাতক পারভেজ ও রোকনের বাড়ি নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায়। স্থানীয় হাজারীবাগ এলাকার আবদুল করিম পিয়ারের ছেলে পারভেজ ও একই এলাকার আবদুল মমিনের ছেলে আবদুর রোকন। গত বৃহস্পতিবার সকালে বালুচরের বাসা থেকে নতুন ক্রয় করা ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে বাসা থেকে বের হয় নাইম। আর বাসায় ফিরেনি। এরপর থেকে সে নিখোঁজ। বাসায়ও ফিরেনি। রিকশাও নেই। এ কারণে নাইমকে নিয়ে চিন্তিত হন তার পরিবারের সদস্যরা। ওই দিন রাতে নাইমের পিতা আব্বাস উদ্দিন ছেলের সন্ধান চেয়ে সিলেটের এয়ারপোর্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।

এরপর থেকে নাইমকে পিতার পাশাপাশি পুলিশও খুঁজছিল। গত শুক্রবার সন্ধ্যার একটু আগে নগরীর বালুচর এলাকার লালটিলা নামক স্থানে বস্তাবন্দি এক কিশোরের লাশ দেখতে পায় স্থানীয়রা। এ লাশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। স্থানীয়রা মানুষের লাশ শনাক্ত করার পর পরই পুলিশকে খবর দেন। খবর পেয়ে এয়ারপোর্ট থানার ওসি শাহাদত হোসেনসহ পুলিশ সদস্যরা সেখানে যান। সেখানে ছুটে যান নাইমের পিতা আব্বাসও। তিনিও গিয়ে পুলিশের উদ্ধার করা নাইমের লাশ শনাক্ত করেন। এদিকে- লাশ উদ্ধারের পর নড়েচড়ে বসে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ। রাতেই তারা অনুসন্ধান শুরু করে। এ সময় তারা নাইমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ তার দুই বন্ধু পারভেজ ও রুকনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। আটকের সময় পারভেজ ও রোকন বাসাতেই ছিল। নাইমের লাশের খোঁজ পাওয়া গেলেও তারা দেখতে যায়নি। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলে খুনের ঘটনা স্বীকার করে তারা দু’জন। এরপর পুলিশ তাদের দেয়া তথ্য মতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ব্যাটারি ও অটোরিকশা উদ্ধার করে। ব্যাটারি বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল দক্ষিণ সুরমায়। আর রিকশা উদ্ধার করা হয় কুমারপাড়ার একটি গ্যারেজ থেকে। এদিকে- গ্রেপ্তারের পর প্রথমে পুলিশকে এবং পরে আদালতে খুনের ঘটনা খুলে বলেছে ঘাতক পারভেজ ও রোকন। তারা জানায়- বৃহস্পতিবারই তারা নাইমের কাছ থেকে রিকশাটি চুরি করে নেয়। কিন্তু পরে নাইম জানতে পারে তার দুই বন্ধু রিকশা চুরি করেছে। পারভেজের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এ কারণে তারা রিকশা থেকে ব্যাটারি আলাদা করে ৬ হাজার ৪০০ টাকায় দক্ষিণ সুরমায় পরিচিত এক জনের কাছে বিক্রি করে দেয়।

এরপর ওই টাকা দিয়ে পারভেজ তার স্ত্রী চিকিৎসা করায়। রাতে বাসায় ফিরে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার যুক্তি করে। এরপর তারা নাইমকে ডেকে এনে শাহী ঈদগাহের করিমের কলোনিতে নিয়ে যায়। সেখানে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে রোকন নাইমকে গলায় গামছা প্যাঁচিয়ে ধরে। তখন চিৎকার শুরু করে নাইম। বাঁচাও বাঁচাও বলেও চিৎকার দেয়। এ সময় পারভেজ রোকনকে বলে- ‘সে (নাইম) আমাকে দুলাভাই ডাকে। তাকে মারিস না। ছেড়ে দে।’ কিন্তু রোকন পারভেজের কথা শুনেনি। সে নাইমের মুখেও গামছা গুঁজে দেয়। এরপর হাত-পা বেঁধে ফেলে। পরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।’ লাশ গুম করে ফেলতে তারা বস্তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর লালটিলার নির্জন স্থানে লাশ ফেলে দিয়েছিল। সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার ওসি শাহাদত হোসেন জানিয়েছেন- পারভেজ ও রোকনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাদের দেয়া তথ্য মতে ব্যাটারি ও রিকশা উদ্ধার করেছে। বৃহস্পতিবার রাতেই খুন করা হয় নাইমকে। ঘাতকরা লাশ গুম করতে বস্তাবন্দি করে। তিনি বলেন- নাইমের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর পারভেজ ও রোকনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন- খুনের ঘটনা স্পষ্ট হয়েছে। সুতরাং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল করবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status