এক্সক্লুসিভ

মুগদা হাসপাতাল

আফিফার সেবায় ব্যস্ত বাবা সাজিদ তখন বেডে একা

হাফিজ মুহাম্মদ

১৭ আগস্ট ২০১৯, শনিবার, ৮:০৪ পূর্বাহ্ন

ছোট্ট শিশু আফিফা। চোখে-মুখে হাসি নেই। মলিন মুখে হাসপাতালের বেডে বসে আছেন। মাঝেমধ্যে বাবাকে বলছেন একটু চুলকিয়ে দাও। ঈদের দিন থেকেই জ্বর। ঈদের পরদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় তার ডেঙ্গু জ্বর। তাকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় গত বুধবার। এর আগে গত রোববার আফিফার বড় ভাই সাজিদকে ভর্তি করা হয় একই হাসপাতালে। সাজিদ এখন কিছুটা সুস্থ হলেও হাসপাতাল ছাড়তে পারেনি। তাকে একাই বেডে কাটাতে হচ্ছে। তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন নবম তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে। আফিফা-সাজিদের বাবা আশরাফ উদ্দিন বাবুল এখন মেয়ের সেবায় ব্যস্ত। ছেলে একটু বড় হওয়ায় তাকে এখন একাই থাকতে হচ্ছে। তাদের দুই জনের জায়গা ভিন্নভিন্ন হওয়ায় ছোট্ট মেয়ের পাশে আছেন বাবুল। গতকাল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে কথা হয় বাবুলের সঙ্গে। তিনি জানান, গত এক সপ্তাহ ছেলেকে নিয়ে এ হাসপাতালেই কাটে তার। সবার বড় ছেলে মানুষিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাদের মা বাসার বাইরে যেতে পারে না। তাকে নিয়ে বাসায় থাকতে হচ্ছে। ছেলে সাজিদকে প্রথমে এ হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর মেয়ের ডেঙ্গু ধরা পড়লে তাকেও এখানে ভর্তি করেন। দুই সন্তান নিয়ে এখন তিনি বিপাকে। ছোট্ট মেয়ের নানা প্রশ্ন। কিন্তু জ্বর কিছুটা কমলেও শরীর প্রচণ্ড দুর্বল। কি করবেন তিনি তা ভেবে পাচ্ছেন না। সাজিদের প্র্লাটিলেট এখন ৮৩ হাজার। চিকিৎসকরা তাকে আরেকটু উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালেই থাকতে বলছেন।
গতকাল দুপুরে সরজমিন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব। কিছু সময় পরপরই রোগী আসছেন। হাসপাতালের মেডিসিন মহিলা ওয়ার্ড, পুরুষ ওয়ার্ড ও শিশু ওয়ার্ডে কোনো সিটি খালি নেই। ওয়ার্ডের সামনের পুরো করিডোরে বেড দেয়া হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের। ফ্লোরেও বেড বিছিয়ে রয়েছেন রোগীরা। বিন্দু পরিমাণ জায়াগা খালি নেই। এরপরও রোগী আসছে। কর্তব্যরত নার্সরা তাদের বেডে বেডে গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, স্যালাইন দিচ্ছেন। শুক্রবার হওয়ায় শুধু দায়িত্বরত চিকিৎসকরা রয়েছেন। তাদের রুমেও প্রেসক্রিপশন নিয়ে রোগীর স্বজনদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। হাসপাতালের দেয়া প্রতিদিনের তথ্য অনুযায়ী গতকাল দুপুর পর্যন্ত এখানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ৮৭ জন। আর গতকাল চিকিৎসারত মোট ডেঙ্গু রোগী ছিল ৩৮৫ জন। একজন রোগী ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে। আর ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে ৬৬ জনকে। বৃহস্পতিবার এ হাসপাতালে নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল ১০৯ জন। ওইদিনও একজন রোগী মারা যায়। এ পর্যন্ত মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ২২৩ জন। কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। হাসাপাতলের দেয়া তথ্য শুধু বেডের রোগীদের। বেডের বাইরে যে অসংখ্য ডেঙ্গু রোগী ফ্লোরে রয়েছে তাদের হিসেব দেয়া হয়নি। আবার প্রকৃত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাটা জানতে চাইলেও ওয়ার্ড থেকে দিতে অপারগতা জানান নার্সরা। শুধু মেডিসিন পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১২০-৩০ জন বলে জানান ওই ওয়ার্ডের এক নার্স। মহিলা ওয়ার্ডে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি । শিশু ওয়ার্ডেও রয়েছে সমান সংখ্যক রোগী। মহিলা ওয়ার্ডের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন রাবেয়া বেগম। পাশে বসে আছেন ছেলে ওমর ফারুক। মাকে নিয়ে গত এক সপ্তাহ তিনি এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে কাটাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন হয়নি এ রোগীর। রাবেয়া বেগমের প্লাটিলেট এতই কম যে তিনি সংজ্ঞাহীন ছিলেন দীর্ঘ সময়। খিলগাঁও ফরাজী হাসপাতালে এক সপ্তাহ চিকিৎসা নেয়ার পর বৃহস্পতিবার ভর্তি করেন এখানে। ওই হাসপাতাল থেকে যেদিন মুগদা হাসপাতালে আসেন সেদিন তার প্লাটিলেট নেমে আসে ৯ হাজারে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার তার প্লাটিলেট একটু বেড়ে ১৩ হাজার হয়। আর গতকাল কি অবস্থা তা দুপুর পর্যন্ত জানতে পারেননি। মায়ের সেবা-শুশ্রষা করছেন ছেলে ও ছেলে বউ। একই ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন মোনালিসা (১৯)। ঈদের পরের রাতে ডেঙ্গু ধরা পরলে এখানে ভর্তি করানো হয় তাকে। অত্যন্ত দুর্বল মোনালিসার পাশে তার বাবা বসে রয়েছেন। তিনি মেয়ের কষ্টের কথা বলছিলেন আর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরছিল। তিনি বলেন ঈদের আগ থেকেই জ্বর থাকায় এবার ঈদে তার মেয়ের মুখে হাসি ছিল না। আর ঈদের দিন শেষ হতে না হতেই জায়গা হয় হাসপাতালে। শিশু ওয়ার্ডের করিডোরে দেখা যায় মায়ের কোলে ঘুমিয়ে শিশু ইয়কুব আলী। দুই বছরের এ শিশুও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। তার পাশে বসে আছে তার নানা। গত ১০ তারিখ তাকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা এ পরিবারের ঈদ কেটে যায় হাসপাতালে। শিশুটি প্রতিনিয়ত দুর্বলই হচ্ছে। চিকিৎসকরা প্রতিনিয়ত দেখছেন। তবে এখনো কবে নাগাদ সুস্থ হবে তা বলতে পারছে না। তবে কিছুটা সুস্থ হয়ে খুশি মাদারটেকের অটোরিকশাচালক মো. শাহজাহান। তিনি গত ৭ই আগষ্ট এ হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর ৯দিন ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়াই করেন। তাকে গতকাল হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। তবে এখনো পুরো শরীরে ব্যথা রয়েছে বলে জানান তিনি। কথা বলতেও কষ্ট হয়। তবুও বাসায় ফিরতে চান। শাহজাহান বলেন, এ হাসপাতালও নিরাপদ নয়। এখানেই মশা বনবন করতে থাকে। কখন পরিবারের অন্যরা অসুস্থ হয় জানিনা। তাই সম্পূর্ণ সুস্থ না হলেও বাসায় যেতে চাই। একটু বিশ্রাম নিলে সুস্থ হতে পারেন বলে জানান। তিনি বলেন, এমন কষ্ট যেনো কেউ না পায় সে প্রার্থনা করি। ঢাকাকে ডেঙ্গুমুক্ত করার জন্য কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিক সে দাবি জানাই।
এদিকে শুক্রবার হওয়ায় হাসপাতালের ডাক্তারদের বেশিরভাগ রুম তালাবদ্ধ। পরিচালকের রুমে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। কয়েকবার রুমে গিয়ে ফেরত আসলে সামনের পিয়ন জানান স্যার কিছু সময় আগে বের হয়ে গেছেন। এদিন হাসপাতাল চারদিক ঘুরে দেখা যায়, পরিচ্ছনতাকর্মীরা আশপাশ পরিষ্কার করছেন। হাসপাতালের ভিতরের ড্রেনে জমে থাকা পানি সরানোর জন্য কাজ করছেন। এছাড়া তারা এডিস মশার লার্ভা ধ্বংশ করছে বলে জানান।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status