প্রথম পাতা

চামড়ার দামে মহা ধস

সিন্ডিকেটের কারসাজি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৫ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:২০ পূর্বাহ্ন

পশুর কাঁচা চামড়া নিয়ে মহা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যা গত ৩০ বছরের মধ্যে সব চেয়ে ভয়াবহ দরপতন। ১৯৯০ সালে ব্যাপক দরপতন হলেও ওই সময় পাঁচ থেকে সাতশ টাকায় বিক্রি হয় গরুর কাঁচা চামড়া। কিন্তু এবার চামড়া কেনার লোকই পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্রি করতে না পেরে অনেকে চামড়া রাস্তায় বা ময়লার স্তূপে ফেলে দিয়েছেন। মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে হাজার হাজার চামড়া। যেসব চামড়া বিক্রি হয়েছে তারও দাম দেয়া হয়েছে নামমাত্র। এমন পরিস্থিতিতে দেশের চামড়া শিল্পে বড় আঘাত আসবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। আগের মজুত থাকায় এবার চামড়ার বাজারে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল আগে থেকেই। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগাম যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেনি। পরিস্থিতি আঁচ করে শেষ মুহূর্তে ঈদের দিন কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত দেয় মন্ত্রণালয়। ঈদের দিনে এমন সিদ্ধান্ত দেয়ায় বাজারে কোন প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন চামড়া ক্রয় বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। কোরবানীর পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ গরিব এবং দুঃস্থদের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। চামড়ার দাম না থাকায় এ শ্রেণির মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন। এছাড়া দেশের হাজার হাজার মাদ্রাসা কোরবানির পশুর চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ব্যয়ের একটি বড় অংশ পূরণ করে থাকে। দাম না পাওয়ায় এসব মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষও বিপাকে পড়েছে।

চামড়ার বাজারের এমন অবস্থার পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা ফায়দা লুটছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগে লোকসানে পড়েছেন মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। বঞ্চিত হয়েছে গরিব, এতিমরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়ার বাজারে ধস নামার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে কম দামে চামড়া কিনতে পারায় এবং এখন কাঁচা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি মেলায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নেবে আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা।
রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার আড়তদাররা বলছেন, ৯০ ভাগ ট্যানারির মালিক পোস্তার পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি। তাই নগদ টাকার সংকটে চামড়া কিনতে পারেননি তারা।  

অন্যদিকে ট্যানারির মালিকরা বলছেন, ঢালাওভাবে অভিযোগ করা ঠিক নয়। কয়েকটি বাদে বেশিরভাগ ট্যানারি পাওনা অর্থ পরিশোধ করেছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, প্রতি পিস ছোট চামড়ার দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাঝারি আকারের প্রতিটি চামড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং বড় চামড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই দাম গত বছরের তুলনায় অর্ধেক। এছাড়া রাজধানীর বাইরে সবচেয়ে ভালো মানের কাঁচা চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়।
এ ছাড়া বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ঘুরে দেখা গেছে, কোরবানি করা বেশিরভাগ পশুর চামড়া রাস্তায় পড়ে আছে। বেলা ১১টা পর্যন্ত কোরবানি সম্পন্ন হওয়া পশুর চামড়াগুলো কেনার জন্য তখনো কেউ আসেননি।

সরকারের নির্ধারণ করে দেয়া দাম অনুযায়ী, ঢাকায় কোরবানির গরুর প্রতিটি ২০ থেকে ৩৫ বর্গফুট চামড়া লবণ দেয়ার পরে ৯০০ থেকে ১ হাজার ৭৫০ টাকায় কেনার কথা ট্যানারি মালিকদের। কিন্তু এবার ফড়িয়া বা মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের দেখা মিলেনি। কোথাও কোথাও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় চামড়া কিনেছেন। আর রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে চামড়া বেচা-কেনা হয়েছে আরো কম দামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার চামড়ার দামে মহাবিপর্যয় নেমে এসেছে। চামড়ার মৌসুমী ব্যবসায়ী হাজী আরফান বলেন, পোস্তায় চামড়া নিয়ে এসেছিলাম। বিক্রি করেছি ৪০৫ টাকা করে। কিন্তু গড়ে চামড়া কিনেছি ৫০০ টাকা ধরে। পরে আবার কিছু চামড়া এনেছি দাম বলছে ২১০-২২০ টাকা। যে দাম গাড়ি ভাড়ার খরচও উঠবে না। উল্টো চার-পাঁচ লাখ টাকা লোকসান। তিনি বলেন, আমি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করি। চামড়ার এত কম দাম কোনো সময় দেখিনি। ট্যানারি ও আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়েছে। তাদের কাছে সবাই এখন জিম্মি।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সেক্রেটারি হাজি টিপু সুলতান বলেন, চামড়ার এই দরপতন গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর নানা করণে চামড়ার দাম কমে যায়। তিনি বলেন, ওই সময় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দামের একটি গরুর চামড়া বিক্রি হতো ৭০০ টাকায়। এবার সেই মানের চামড়া কেনা সম্ভব হয়েছে ৩০০ টাকারও কম দামে। ট্যানারি মালিকরা আমাদের পাওনা টাকা পরিশোধ করেনি অভিযোগ করে বলেন, তারা টাকা আটকে রেখেছে। টাকা না থাকলে আমরা চামড়া কিনব কীভাবে? তাই দাম পড়ে গেছে। চামড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। অনেক চামড়া পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এখন করণীয় কী- জানতে চাইলে টিপু সুলতান বলেন, পোস্তার ব্যবসায়ীরা সাধ্যমতো চামড়া কিনেছে। এখন আড়তে চামড়া না এনে যে যেখানে চামড়া কিনছেন সেখানেই লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। তা ছাড়া কোনো কিছু করার নেই।

চামড়ার দরপতনের বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ট্যানারির মালিকরা পাওনা অর্থ পরিশোধ করছে না, এ কথা ঠিক নয়। ঢালাওভাবে অভিযোগ করাও ঠিক হচ্ছে না। কারণ বেশিরভাগ ট্যানারি আড়তদারদের টাকা দিয়েছে। তারা কম দামে চামড়া কিনছে। আমাদের কাছে বেশি দামেই চামড়া বিক্রি করবে। লবণযুক্ত চামড়া আমাদের ১ হাজার টাকার উপরে কিনতে হবে। তিনি বলেন, গরু জবাইয়ের ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে চামড়া সংরক্ষণ করলে চামড়া ভালো থাকে। ১৫ থেকে ২০ দিন পর ট্যানারিগুলো চামড়া কেনা শুরু করবে। যেসব চামড়া ভালো থাকবে তা সরকার নির্ধারিত দামে কিনব। তিনি বলেন, এবার ৮৫ লাখ কাঁচা চামড়ার সংগ্রহের লক্ষ্য ঠিক করেছি। তবে এবার কোরবানি বেশি হয়েছে। তাই লক্ষ্য অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহের কোনো সমস্যা হবে না।

জানা গেছে, সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর, রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়া ও অর্থ সংকটের কারণে এ বছর চামড়ার দাম কমানোর সুপারিশ করেছিল কাচা চামড়ার ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা। এসব বিবেচনায় সরকার দাম না বাড়িয়ে আগের মূল্য নির্ধারণ করে।

চামড়ার কম দাম ব্যবসায়ীদের কারসাজি: বাণিজ্যমন্ত্রী
রংপুর প্রতিনিধি জানান, চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল রংপুরের শালবন এলাকায় নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চামড়া নিয়ে যখনই ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখনই তার বিরুদ্ধাচরণ করা হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ঈদের আগে ট্যানারি মালিক ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
চামড়ার দাম একেবারেই কমে গেছে উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণেই সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মন্ত্রী জানান, সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলছেন। টিপু মুনশি আরো বলেন, কোনোভাবেই চামড়াশিল্পকে ধ্বংস করতে দেয়া যাবে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status