বাংলারজমিন

বান্দরবানে ৩ মাসে ৬ খুন

ভয়ে ঘরছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা

নুরুল কবির, বান্দরবান থেকে

১০ আগস্ট ২০১৯, শনিবার, ৮:১১ পূর্বাহ্ন

বান্দরবানে হত্যা ও অপহরণ আতঙ্কে দিনের পর দিন ঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকার  আওয়ামী লীগ নেতারা। এমনকি অনেক গ্রাম এখন রাতের বেলা পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। গত তিন মাসে ৩ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার পর থেকে তাদের মধ্যে এ আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অপর দিকে মামলার ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নেতারা। আওয়ামী লীগ নেতা হত্যায় একের পর এক জেএসএস নেতাকর্মীদের অভিযুক্ত করে মামলা দেয়ায় জেলা শহর ও উপজেলার নেতাকর্মীরা এখন এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছে। সম্প্রতি রোয়াংছড়ি উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা মং মং থোয়াই হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাত ১৫ জেএসএস সন্ত্রাসীকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর আগে গত ২২শে মে পৌর আওয়ামী লীগ নেতা চথোয়াই মং হত্যা মামলায় জনসংহতি সমিতি জেএসএস এর ১৫ নেতাসহ অজ্ঞাত ৭০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় জেএসএস এর কেন্দ্রীয় নেতা ও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং, জেএসএস বান্দরবান জেলার সাধারণ সম্পাদক সাবেক রোয়াংছড়ির উপজেলার চেয়ারম্যান ক্য বা মংসহ বেশ কয়েকজন কারাগারে রয়েছে। তাই গ্রেপ্তারের ভয়ে দলটির নেতাকর্মীরা এখন গা ঢাকা দিয়েছে। আর এ ঘটনার পর থেকে পার্বত্য জেলা বান্দরবানে জেএসএস ও আওয়ামী লীগ মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হওয়ার পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জনসংহতি সমিতি জেএসএস এর সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। বিভিন্ন সময় জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থনও দিয়েছে জেএসএস। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রামের কারণে ধীরে ধীরে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জেএসএস এর সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা প্রসন্ন কান্তি তঞ্চগ্যা নির্বাচনে প্রার্থী হলে জেএসএস তাকে সমর্থন দেয়। এরপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে জেএসএস এর সম্পর্কে প্রকাশ্য দূরুত্বের সৃষ্টি হয়। ২০১৬ সালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মংপ্রু অপহরণের ঘটনায় জেএসএসকে দায়ী করে শীর্ষ নেতাদের আসামি করে মামলা দায়ের করায় দূরত্ব থেকে দ্বন্দ্বে রূপ নেয় আওয়ামী লীগ জেএসএস এর সম্পর্ক। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে জেএসএস এর দখলকৃত বিভিন্ন উপজেলা চেয়ারম্যানের আসন ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতারা নিয়ে নিলে দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছে। ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে উঠতে থাকে শান্তি সমপ্রীতি খ্যাত পার্বত্য জেলা বান্দরবান। শুরু হয় খুন পাল্টা খুন। গত ৩ মাসে খুন হয়েছে ৬ জন। এর মধ্যে ৩ জন জেএসএস ও ৩ জন আওয়ামী লীগ নেতা। অপহরণ হয়েছে ২ জন। আওয়ামী লীগ নেতা হত্যায় জেএসএসকে দায়ী করলেও অভিযোগ অস্বীকার করে দলটির নেতারা। অন্যদিকে জেএসএস কর্মীদের হত্যায় মগ লিবারেশন পার্টি নামে একটি সংগঠনকে দায়ী করে জনসংহতি সমিতি জেএসএস। আর এ দলটির পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জড়িত বলেও অভিযোগ করেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেএসএস’র এক নেতা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করতে চুক্তি বিরোধী একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের কর্মীদের হত্যা করছে মগ বাহিনীর সদস্যরা। আর এ মগ বাহিনীকে মদত দিচ্ছে সরকারি দলের জ্যেষ্ঠ নেতা। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের একটি বিচ্ছন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপ বান্দরবান জেলায় ঢুকে পড়েছে। তাদের সঙ্গে বিপদগামী কিছু মার্মা সমপ্রদায়ের যুবক যোগ দিয়েছে আর এদেরকে এখানে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকারি দলের নেতারা এবং আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার অভিযোগে তাদের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির করা হচ্ছে যাতে চুক্তির আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করা যায়। বর্তমানে আমাদের সব নেতাকর্মী ঘরবাড়ি ছেড়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রেপ্তারের ভয়ে।
অপর দিকে আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, সরকার শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক ইতিমধ্যে চুক্তির বেশিরভাগ ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে কিন্তু সরকারের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে শান্তির জেলা বান্দরবানকে অশান্ত করতে জেএসএস এর সন্ত্রাসীরা একের পর এক আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা অপহরণ ও চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি হিট লিস্ট তৈরি করেছে এবং সে অনুযায়ী হত্যা করছে। হত্যার ভয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে বাসা ভাড়া করে বসবাস করছে। তারা সবাই অমানবিক জীবনযাপন করছে। এদিকে নিজেদের মধ্যে আদিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

বান্দরবান পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার বলেছেন, সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে আদিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে। আমরা আমাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছি। দুর্গম অঞ্চল ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে আমাদের একটু সময় লাগছে। পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতেই আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের হুমকি বা তালিকার কোনো খবর আমাদের কেউ দেয়নি। তবে আমরা সার্বিকভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি। বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছি এবং কারা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। উল্লেখ্য, গত মে মাসে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে বান্দরবানের রাজবিলা ইউনিয়নের তাইংখালী বাজারে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের হামলায় পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সহযোগী সংগঠন যুব সমিতির সদস্য বিনয় তঞ্চঙ্গ্যা (৩৫) কে গুলি করে হত্যা, ঐদিন রাতে রাবার বাগানের শৈলতন পাড়া থেকে পুরাধন তঞ্চঙ্গ্যা (৩২) নামে যুব সমিতির আরেক কর্মীকে অপহরণ করা হয়। পরের দিন জেএসএস কর্মী পুত্রকে খুঁজে না পেয়ে পিতা জয়মনি তঞ্চঙ্গ্যাকে (৫২) গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একদিন পর আওয়ামী লীগের কর্মী ক্যচিং থোয়াই মারমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর ২৫শে মে বান্দরবান পৌর শাখার আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চথোয়অই মং মারমাকে অপহরণের পর গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এরপর ২৫ জুন রোয়াংছড়ি উপজেলায় বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কর্মী অংথুই চিং মারমাকে (৩৮) গুলি করে হত্যা করে অস্ত্রধারীরা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status