এক্সক্লুসিভ

ক্ষমতা কি বিবেকের ডাক শুনতে পায়?

অনুপম কাঞ্জিলাল

৮ আগস্ট ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:১৩ পূর্বাহ্ন

কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল ও বিশেষ মর্যাদা রদ নিয়ে নেতা-মন্ত্রীদের পাশাপাশি সারা দেশের মানুষ তাদের মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু জানা যাচ্ছে না যাদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে সরকার এত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন এক্ষেত্রে তাদের মতামতটা ঠিক কী? কাশ্মীরের মানুষ কী ভাবছেন তার কোনো প্রকাশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। বলা হচ্ছে, এতদিনে কাশ্মীরকে ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল স্রোতে নিয়ে আসা হলো। অথচ গত কয়েকদিনে গোটা কাশ্মীরকে মুড়ে ফেলা হয়েছে সেনাবাহিনী দিয়ে। বন্ধ  করে দেয়া হয়েছে সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। ইন্টারনেট পরিষেবা, টেলিভিশন বা রেডিও সমপ্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে। গোটা উপত্যকা জুড়ে চলছে অনির্দিষ্ট সময়ের কারফিউ। সেখানকার নেতা-নেত্রীরা সব গৃহবন্দি বা গ্রেপ্তারের শিকার। এই সব ব্যবস্থার কোন্‌টা গণতন্ত্রের অনুগামী? গণতন্ত্র মানে তো নাগরিকদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে চালিত ব্যবস্থাপনা, কাশ্মীরে তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? কাশ্মীরে রাষ্ট্রের এই কর্তৃত্ববাদী আগ্রাসনে যারা উৎফুল্ল তারা ভেবে দেখেছেন তো রাষ্ট্রের এই কর্তৃত্ববাদ একদিন আপনার নাগরিক জীবনের পরিসরেও আচমকা ঢুকে পড়তে পারে। আপনি কী খাবেন, পরবেন, কার সঙ্গে মিশবেন, কী কথা বলবেন সব নির্ধারণ করে দিতে পারে রাষ্ট্র, কারণ মনে রাখবেন রাষ্ট্রের হাতে এখন ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী চিহ্নিত করার আইন এসে গেছে। কাশ্মীরবাসীর কোনো মত না নিয়ে তাদের অবরুদ্ধ করে রেখে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়ার মধ্যে যারা ক্ষমতার আধিপত্য বা ঔদ্ধত্যকে দেখতে পাচ্ছেন না, তারা বোধকরি চোখ থাকতেও অন্ধ।
এক অদ্ভূত জাতীয়তাবাদের জিকির তোলা হচ্ছে, যার সঙ্গে যুক্তি ও বুদ্ধির খুব একটা যোগ নেই। এমনকী যা বিবেক-মানবিকতার দাবিকেও অগ্রাহ্য করতে চাইছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করতে হবে, বিশেষ মর্যাদাও তুলে নিতে হবে। কারণ এক দেশে এক ব্যবস্থা থাকা জরুরি- মোটামুটি এই ভাবনার উপর দাঁড়িয়ে যারা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের এই অতি দ্রুত নেয়া ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন, তাদের জন্য কিছু তথ্য দেয়া দরকার। প্রথমত ৩৭০ ধারা কাশ্মীরে লাগু তো এমনি এমনি হয়নি, তার ঐতিহাসিক একটা প্রেক্ষাপট আছে। কাশ্মীর এক সময় একটা স্বাধীন ভূখণ্ডই ছিল, সেই ভূখণ্ড না ছিল পাকিস্তানের, না ছিল ভারতের। স্বাধীন কাশ্মীরের শেষ রাজা ছিলেন হরি সিং। এক সময় স্বাধীন কাশ্মীর ভূখণ্ডকে পাক হানা থেকে বাঁচাতে তিনি ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হন। এই কারণে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে ভারত সরকার। ভারতের সংবিধানে জায়গা পায় ৩৭০ ধারা। ভারতভুক্তির কথা চুক্তিতে না থাকলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পরবর্তী সময় ভারত সরকারের হয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কাশ্মীরের অবস্থা স্বাভাবিক হলে ও পাকস্তানি হানাদারদের কাশ্মীর থেকে হটিয়ে দেয়ার পর সেখানকার মানুষের মতামত নিয়েই কাশ্মীর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। ৩৭০ ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সবই অস্থায়ী ব্যবস্থা বলেই গৃহীত হয়েছিল। এখন অস্থায়ী ব্যবস্থা বলে ৩৭০ ও বিশেষ মর্যাদা তুলে দেয়ার পক্ষে জোরদার যুক্তি দিচ্ছেন যারা তারা কাশ্মীরের মানুষের মতামত নেয়ার বিষয়টি একেবারে এড়িয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নিয়ে রাষ্ট্রপতি জম্মু কাশ্মীরের বিধানসভার অনুমোদন ছাড়া ৩৭০ ধারা খারিজ করতে পারেন না বলেও মত বিরোধীদের একাংশের। এক দেশ এক আইনের যুক্তি যারা দিচ্ছেন তারা কেন বলছেন না যে, বিশেষ মর্যাদা শুধু কাশ্মীর রাজ্যই পায় না, এই মুহূর্তে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আর ৯টি রাজ্য এই মর্যাদার অধিকারী। তাহলে শুধু কাশ্মীর নিয়ে কেন এত গাত্রদাহ?
কাশ্মীরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস হচ্ছে, অথচ কেড়ে নেয়া হচ্ছে রাজ্যের স্বীকৃতি, রাজ্যের নাগরিককে নাগরিক থেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে প্রজার স্তরে, কেড়ে নেয়া হচ্ছে তাদের স্বাধীন চলা ফেরার পরিসর, স্বাধীন মত প্রকাশের যাবতীয় সুযোগ। কোন গণতন্ত্রের সূচনা এটা? আমরা ভুলে যাচ্ছি কাশ্মীরবাসীর কান্না শুনতে, তাদের যন্ত্রণা হাহাকারকে অনুভব করতে। কাশ্মীরের যে ছোট্ট শিশুটি সেনার বিরুদ্ধে তার প্লাস্টিকের গুলতি তাক করে ইট ছুড়েছিল, সেটা আসলে একটা বার্তা, ক্ষমতার আগ্রাসন ও নির্দয়তার বিরুদ্ধে কাশ্মীরের আমজনতার ধিক্কার ও ঘৃণার বার্তা। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের একমুখী ক্ষমতার আধিপত্য প্রয়োগের তাড়নাকে যারা জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম বলে ভাবছেন, তারা হয়তো মনে রাখতে পারছেন না যে, দেশ মানে কোনো ভূখণ্ড, নদী, পাহাড়-পর্বত, পাথর নয়। দেশ মানে হচ্ছে দেশের মানুষ, সেই মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা, হাহাকার- কান্নাকে স্পর্শ করতে না জানলে দেশপ্রেম মিথ্যে-ফাঁকি। মিথ্যে দেশপ্রেমের উন্মাদনা তৈরি করে ক্ষমতা ভোগ করা যায়, ভূখণ্ড জয় করা যায় কিন্তু মানুষের হৃদয় জয় করা যায় না। কাশ্মীরকে জয় করতে তাই সেখানকার মানুষের হৃদয় জয় করা জরুরি, তাদের কান্না শোনা জরুরি। কাশ্মীরের মানুষের হৃদয় জয় করতে পারলে সেনা লাগবে না, গোলাবারুদ লাগবে না, অন্তরের তাগিদই কাশ্মীরবাসীকে চালিত করবে ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল স্রোতে। তবে ক্ষমতা কী কোনোদিন হৃদয়-বিবেকের ডাক শুনতে পাবে! জানা নেই, কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে আপাতত কাশ্মীর উপত্যকা আবার এক রক্তাক্ত উপাখ্যান তৈরিরই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাশ্মীরিদের বাদ দিয়ে ভারত সরকার শুধু কাশ্মীর পেতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে না কি?
(ভারতীয় অনলাইন সাতদিন ডট ইন-এ প্রকাশিত লেখার সমপাদিত রূপ।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status