শিক্ষাঙ্গন

শিক্ষা ব্যয়েও দামের প্রভাব

পিয়াস সরকার

২৫ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৫ পূর্বাহ্ন

আকাশচুম্বী নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আবার দাম বাড়ার ছোঁয়া লেগেছে শিক্ষা উপকরণেও। বেড়েছে বই, ড্রেস, কাগজ, কলমসহ সকল উপকরণের দাম। সমাজের উচ্চ বিত্তে প্রভাবটা প্রকট না হলেও শিক্ষা উপকরণের মূল্য বাড়ার প্রভাব নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পাহাড়সম। এ কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। রংপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রায় ৬ বছর ধরে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করছে স্বেচ্চাসেবী সংগঠন হিউম্যান ইফোর্টস ফর লোকাল পিপল (হেল্প)। এর একজন কর্মী ফাহমিদ হাসিব বলেন, বিনামূল্যে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করছে। আবার উপবৃত্তিও পাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা উপকরণের প্রভাব প্রকট। যার ফলে ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থী। আরেকজন কর্মী রকিবুল ইসলাম বলেন, হতদরিদ্র অভিভাবকরা উপবৃত্তির টাকা খাবারের পেছনে ব্যয় করেন। তাদের শিক্ষা উপকরণের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় একবেলা খাওয়া।

এই সংগঠনের আরেক সদস্য তাসমিয়া আফরিন বলেন, একটা ক্লাসে ২০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও ৫-৭ জনের কাছে কলম মেলে। ৫ টাকা দিয়ে কলম কেনার সামর্থ অনেকের নেই। আর খাতা এমনভাবে ব্যবহার করে যাতে এক খাতায় চলে দীর্ঘ দিন। ৩০ পাতার ২-৩টি খাতায় পুরো এক বছর পার করে এমন অনেকে আছে।

বছর দুয়েক আগে একটি জরিপ করে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। দেশের ৮টি জেলার ৪৩টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো ‘বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন স্টাইপেন্ডস: এ কোয়ালিটেটিভ অ্যাসেসমেন্ট’ এই গবেষণায় উঠে আসে- প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাগ্রহণে একজন শিক্ষার্থীর বছরে খরচ হয়  ৪ হাজার ৭শ’ ৮৮ টাকা। খাতা, কলম, পেন্সিল বাবদ খরচ হয় ১ হাজার ২ শ’ ৭৩ টাকা। আর ৪শ’ ১৩ টাকা খরচ হয় সহায়ক বই ক্রয়ে। আর পোশাক ক্রয়ে খরচ হয় ৫শ’ ১৫ টাকা।

২০১৮ সালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক গবেষণায় দেখা যায়- শিক্ষা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে গ্রামাঞ্চলে ঝরে পড়ছে ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। তারা ২০ টি বিদ্যালয়ের ২ হাজার শিক্ষার্থীদের নিয়ে গবেষণা করেন মানিকগঞ্জের ৪টি উপজেলায়। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করেন, লালমনিরহাট জেলার ৫টি বিদ্যালয়ে। সেখানে তারা দেখেন, প্রাথমিকে ঝরে পড়ে ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এই ৩১ শতাংশের ৪১ শতাংশ ঝরে পড়ার পেছনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কারণ শিক্ষা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি। তারা জরিপটি করেন ২০১৭ সালে।

এবার দেখে নেয়া যাক গত বছরের তুলনায় এবছরের শিক্ষা উপকরণের বাজারের চিত্র। কয়েক মাস আগেও বসুন্ধরা ও মেঘনা গ্রুপের এক টন কাগজের মূল্য ছিলো প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়। পারটেক্স গ্রুপের কাগজের দাম ৮০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫/১০ হাজার টাকা। আর কাটিং পেপার ও নিউজ প্রিন্টের দাম বেড়েছে টন প্রতি প্রায় ২০ হাজার টাকা। এখন বিক্রি হয় প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায়। আর আমদানি করা কাগজের মূল্য ৭০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ হাজার টাকায়। বাবু বাজারের কাগজ ব্যবসায়ী দিদারুল আলম বলেন, কাগজের পাল্প আগে আমদানী করা হতো ৪৫০ ডলারে। আর এখন করতে হয় ৭৫০ থেকে ৮০০ ডলারে। আর গ্যাস, বিদ্যুতের মুল্য বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির প্রভাব দেখা যায় বাজারে।

রাজধানীর কাওরান বাজার ও শুক্রাবাদ এলাকার বেশ কয়েকটি স্টেশনারি দোকানে কথা বলে জানা যায়, এ ফোর সাইজের স্বচ্ছ কাগজের তৈরি খাতার দাম এখন ৪০ টাকা। যা বছর খানেক আগেও তারা বিক্রি করেছেন ৩০ টাকায়। আবার ব্রড শিটের খাতা, যেগুলো বাজারে ইউনিভার্সিটি খাতা নামে পরিচিত। সেসব খাতা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। যা জানুয়ারি মাসে ছিলো ৪০ টাকা। আর বছর খানেক আগে ছিলো ৩০ টাকা। আর ছোট লাইন টানা খাতার দাম ২০ টাকা। কিছুদিন আগে যার মূল্য ছিলো ১০ টাকা। এই খাতা ৫ টাকাও বিক্রি হয়েছে আগে। একেইভাবে ১২০ পেজের আর্ট পেপার বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়। যা আগে ছিলো ৯০ টাকা।

কাগজের পাশাপাশি বেড়েছে কলম, পেন্সিল ও রং পেন্সিলের দামও। তবে বাজারে কলমের দাম বৃদ্ধি চোখে পড়েনি। কারণ ৫ টাকার কলম ৫ টাকাই রয়েছে। তবে দোকানীরা বলেন, যতো দিন যাচ্ছে দাম না বাড়লেও কমছে কলমের কালির পরিমাণ। অন্যদিকে বছরখানেক আগে ১২০ টাকায় বিক্রি হওয়া পেন্সিলের বক্স বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। কালার পেন্সিলের বক্স ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা। যার মূল্য ছিলো ২৫০ টাকা।

অপরদিকে বেড়েছে স্কুল ব্যাগের দামও। রাজধানীর নীলক্ষেতের ব্যাগ ব্যবসায়ী সোহরাব হোসেন বলেন, ২ পার্টের ৪ চেইনের একটি ভালো মানের স্কুল ব্যাগের দাম ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা। বছর খানেক আগে যার দাম ছিলো ৮শ’ থেকে হাজার টাকা। আর এখন স্কুল ব্যাগের সর্বনিম্ন মানের এক পার্টের ২ চেইনের ব্যাগের দাম ৫-৬শ’ টাকা। যা বছরে বেড়েছে ২-৩শ’ টাকা।

সব কিছুর সঙ্গে বেড়েছে কাপড়ের দামও। গত বছর এক গজ সাদা কাপড়ের দাম ছিলো ৬০ টাকা। কিন্তু এখন কিনতে হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। আর রঙ্গিন কাপড়ের দাম গজপ্রতি বেড়েছে প্রায় ৪০ টাকা। ১১০ টাকার এক গজ কাপড় বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা।

পোশাক বানানোর ক্ষেত্রেও বেড়েছে খরচ। শার্ট-প্যান্ট বানানোর খরচ আগে ছিলো ৫-৬শ’ টাকা। তা এখন বানাতে লাগছে কমপক্ষে ৮শ’ টাকা। আর কামিজ বানানোর খরচ বছর খানেক আগে ছিলো ৩শ’ টাকা তা এখন হয়েছে সাড়ে ৪শ’ টাকা।

শিক্ষা উপকরণের প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষাবিধ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, গ্রামে হত দরিদ্র মানুষ তার সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানোটা ক্ষতি বলে মনে করেন। কারণ এই সময়ে তারা কোন কাজে সন্তানকে ব্যবহার করতে পারতেন। আর মূল্যবৃদ্ধি তো আছেই। আমি মনে করি, সকলকে বিনামূল্যে বই দেবার কোন প্রয়োজন নাই। যাদের বই কেনার সামর্থ আছে তারা এই বই পাবে না। আর এই টাকা দিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় একটি সুসজ্জিত ব্যাগ দিতে পারি। যাতে থাকবে বছর ব্যাপি ব্যবহারের জন্য খাতা-কলম-জ্যামিতি বক্স ইত্যাদি। আর বই উৎসবের সময় তাদের দেয়া যেতে পারে ২ জোড়া পোশাক। ফলে অভিভাবকদের কোন বাড়তি চাপ থাকবে না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status