শেষের পাতা

রিফাত হত্যা

মিন্নিকে নিয়ে পাল্টাপাল্টি

মো. মিজানুর রহমান, বরগুনা থেকে

১৫ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ৯:৩১ পূর্বাহ্ন

বরগুনায় প্রকাশ্যে শাহনেওয়াজ রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় এর আগে নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানালেও এবার তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকেই ছেলে হত্যার সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করছেন রিফাতের বাবা ও মামলার বাদী আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। শনিবার রাত ৮টায় বরগুনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এ 
দাবি জানান।সংবাদ সম্মেলনে তিনি রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান। মিন্নি ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মিন্নির প্রথম বিয়ের তথ্য লুকানো এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মিন্নির সম্পৃক্ততার অভিযোগসহ ১০টি গুরুতর অভিযোগ তোলেন দুলাল শরীফ। অপরদিকে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দুলাল শরীফের মাথা ঠিক নেই, তিনি ভুলভাল বকছেন।

গত ৬ই জুলাই রিফাত হত্যার নতুন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে কলেজের প্রধান ফটক থেকে মিন্নিকে নিয়ে রিফাতকে বের হতে দেখা যায়। পরে মিন্নি ফের কলেজের ভেতরের দিকে যায়। এ সময় রিফাত তার স্ত্রী মিন্নিকে ভেতরে যেতে বাধা দেয়। এরপরই সন্ত্রাসীরা কলেজ গেট থেকে রিফাতকে ধরে সামনের দিকে নিয়ে যায়। মিন্নি তখন পেছন পেছন হাঁটছিল। কয়েক সেকেন্ড পরেই নয়ন বন্ড ও অন্যরা যখন রিফাত শরীফকে কিল, ঘুষি, লাথি দিতে শুরু করে, তখনই মিন্নি তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়। আর যখন সন্ত্রাসীরা রিফাত শরীফকে কোপাতে শুরু করে তখন মিন্নি হামলাকারীদের নির্বৃত্ত করার চেষ্টা করে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, আসামিরা মিন্নির ওপরে চড়াও হয়নি এবং মিন্নি কোনোভাবেই আক্রান্ত হয়নি। তার প্রশ্ন, ‘মিন্নি কেন আক্রান্ত হয়নি?’

এ সময় মিন্নি বিবাহিত ছিল এবং আগের বিয়ের তথ্য গোপন করেছে এমন অভিযোগও করেন তিনি। এ ছাড়াও তার ছেলেকে হত্যার আগের দিন মিন্নি নয়ন বন্ডের বাসায় গিয়েছে এমনটা জেনেছেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি নিজের উপলব্ধি থেকেই সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়েছি।
রিফাত হত্যার প্রধান সাক্ষী মিন্নিকে অভিযুক্ত করলে মামলায় এর প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি আমার ছেলের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’
আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বলেন, মিডিয়ায় প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায় রিফাতকে কোপানোর সময় মিন্নি খুনিদের জাপটে ধরেছে। কিন্তু খুনিরা কেউ মিন্নির ওপর চড়াও হয়নি এমনকি মিন্নিকে একটা টোকাও দেয়নি। যখন রিফাত আহত এবং রক্তাক্ত অবস্থায় একা একা রিকশাযোগে হাসপাতাল যাচ্ছিল তখন মিন্নি তার ব্যাগ ও স্যান্ডেল গোছানোর কাজে বেশি ব্যস্ত ছিল। খুনিদের একজন রাস্তা থেকে ব্যাগ তুলে মিন্নির হাতে দিয়েছে। মিন্নি ওই ব্যাগ নিয়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটছিল। এ ছাড়া আমার ছেলে রিফাত শরীফকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার সময়ও যায়নি মিন্নি। আসলে সবই ছিল মিন্নির অভিনয়।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, নিহত রিফাত শরীফের চাচা আবদুল আজিজ শরীফ ও ছালাম শরীফ।

মিন্নির বক্তব্য: এদিকে, মিন্নি দাবি করে, ‘কিছু লোক আছে যারা বিষয়টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। আমি চরম মানসিক নিপীড়নে ভুগছি। কেউ আমাদের পাশে নেই, সবাই শুধু সমালোচনায় মুখর। আমি সবার সহযোগিতা চাই।’

রিফাত শরীফের ওপর হামলার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মিন্নি বলে, ‘ওইদিন সকাল সোয়া ১০টা হয়তো। রিফাত আমাকে বলে, ‘আব্বু আসছে, চলো, তোমার সঙ্গে দেখা করবে।’ আমি ওকে বলেছিলাম ‘আমার কাজ শেষ করে বের হই।’ ও আপত্তি করে বলে, ‘আব্বু গেটে অপেক্ষা করছে।’ আমি তখন ওর সঙ্গে বের হই। গেটের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বাবা কোথাও নেই। তখন আমি বলি, ‘তুমি মিথ্যে বলেছো, চলো রুটিন নিয়ে আসি।’ আমি ওকে নিয়ে ভেতরে যেতে চাই। ঠিক এ মুহূর্তেই ১০-১২ জন আমাদের ঘিরে ধরে এবং রিশান ফরাজী ওর পথরোধ করে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে ওদের পেছনে হাঁটতে থাকি। পরে যখন আক্রমণ করে তখন প্রতিরোধের চেষ্টা করি। আমি হেল্প চাই অনেকের কাছে। কেউ আসেনি। ওরা চলে যাওয়ার পর রিফাত নিজেই হেঁটে রিকশায় ওঠে। আমার পায়ের পাতা কেটে যাওয়ায় জুতো ছাড়া হাঁটতে পারছিলাম না, তখন জুতো পায়ে দিই। এ সময় একজন আমার হাতে ব্যাগ তুলে দেয়।’

রিফাতের বাবার মাথা খারাপ: মিন্নির বাবা: রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফের অভিযোগ সম্পর্কে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, ‘দুলাল শরীফের মাথা ঠিক নেই। দুলাল শরীফ হার্টের রোগী। এ কারণে তিনি ভুলভাল বকছেন। তার কথার কোনো ভিত্তি নেই। তার কথায় কান দেয়ারও কিছু নেই।’
মিন্নির বাবা বলেন, ‘রিফাতের ওপর হামলার পর আমি রিফাতকে আমার খরচে বরিশাল নিয়ে যাই। বরিশাল নেয়ার পর সেখানে কিছু লোক আমার ওপর হামলা করে। সেসব হামলাকারীর প্ররোচনায় মূলত এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে।
আমার মেয়েটি বিধবা হয়েছে। মেয়ে জামাইয়ের জন্য আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ভিডিও ফুটেজে রিফাত শরীফকে বাঁচানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা দেখে হাজার হাজার মানুষ আমার মেয়ে মিন্নিকে বাহবা দিয়েছে। আমার মেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিফাতকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। তারপরও আমার মেয়ে ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ।’
মিন্নিকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বলেন, রিফাত হত্যা মামলাটি স্পর্শকাতর। মামলাটি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করছি। এ হত্যাকাণ্ডে যে জড়িত থাকবে পুলিশ তাকে আইনের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর।

খুনিদের আড়াল করতে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: মিন্নি
‘বরগুনায় যারা বন্ড ০০৭ গ্রুপ সৃষ্টি করেছেন, তারা খুবই ক্ষমতাবান ও অর্থশালী। তারা রিফাত হত্যার বিচারকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য আমার শ্বশুরকে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। আমার স্বামীর খুনিদের আড়াল করতে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’ গতকাল দুপুর ১টার দিকে বরগুনা পৌর শহরের নয়াকাটা মাইঠা এলাকায় তার বাবার বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে রিফাত হত্যা মামলার ১ নম্বর সাক্ষী ও নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি এসব কথা বলেন। এ সময় তার শ্বশুরের করা সংবাদ সম্মেলনের অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন দাবি করে মিন্নি বলেন, ‘২৬শে জুন আমার চোখের সামনে আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আমি সন্ত্রাসীদের বারবার প্রতিহত করার চেষ্টা করেও আমার স্বামীকে বাঁচাতে পারিনি। সবার কাছে সহযোগিতা চাইলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এরপর ২৭শে জুন আমার শ্বশুর বরগুনা সদর থানায় ১২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। হত্যা মামলায় আমাকে কোথাও অভিযুক্ত না করে ১ নম্বর সাক্ষী বানানো হয়। এখন হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে মামলাটি ভিন্ন খাতে নেয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’

এ সময় সিসিটিভি ফুটেজের কথা উল্লেখ করে মিন্নি বলেন, ‘অনেকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আমার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু আসল ঘটনা জানার চেষ্টা কেউ করেন নি। আমি সেদিন কলেজে গিয়েছিলাম। রিফাত গিয়ে আমাকে বলে বাবা এসেছেন তোমাকে ডাকছে। আমি এসে দেখি রিফাতের বাবা (আমার শ্বশুর) সেখানে নেই। তাই আমি আবার কলেজের ভেতরে ঢুকে যেতে চাইছিলাম। এ সময় রিফাত আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার আবদার করে। এর মধ্যেই রিশান ফরাজী, রিফাত ফরাজীসহ কয়েকজন এসে ওকে জাপটে ধরে পূর্ব দিকে নিয়ে যায়। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে যাই। হাঁটতে হাঁটতে তাদের পেছনে যাই। যখন দেখি রিফাতকে মারধর শুরু করেছে, আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছি তাকে বাঁচাতে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তাকে রক্ষা করতে পারিনি।’
মিন্নি আরো বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বরগুনার পুলিশ সুপার ও প্রশাসনকে আমি ধন্যবাদ জানাই আমার নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুবিচারের জন্য আবেদন করছি। আমার বিরুদ্ধে যারা মিথ্যাচার ও ষড়যন্ত্র করছে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবিসহ প্রকৃত সত্য উদঘাটনের জন্য আবেদন করছি।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status